শামীম মাথা নাড়ল, বলল, “উহুঁ”। সেটা মনে হয় এখনো কেউ ধরতে পারে নি। সবাই ভেবেছে তুই খুব ভালো সাতার কাটতে পারিস। এই পর্যন্তই। কিন্তু তুই যে আসলে সাঁতার কাটিস না, তুই যে পানির নিচে মাছের মতো ঘুরে বেড়াস সেটা কেউ ধরতে পারে নাই, কারণ সেটা কেউ একবারও চিন্তা করে নাই।”
সেরিনা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, সবাই জিজ্ঞেস করেছে কেমন করে এতে ভালো সাঁতার কাটতে শিখেছি।”
শামীম বলল, “যাই হোক যেটা হয়ে গেছে ভালো ভাবেই হয়েছে। একটা বাচ্চাকে প্রাণে বাঁচিয়েছিস। সেটা নিয়ে বেশি হইচই হয় নি। এখন থেকে খুব সাবধান। তোর যে একটা অস্বাভাবিক ক্ষমতা আছে সেটা কেন কেউ জানতে না পারে।”
সেরিনা বলল, “কেউ জানবে না আব্বু। তুমি নিশ্চিন্ত থাক।”
.
কিন্তু এতো নিশ্চিন্ত থাকা গেল না, কারণ পরের দিনই বড় আপা ক্লাশের মাঝখানে সেরিনাকে ডেকে পাঠালেন। বড় আপার অফিসে ঢুকে সেরিনা দেখল সেখানে তাদের স্পোর্টস টিচার নাজমা ম্যাডাম ছাড়াও আর দুই একজন স্যার ম্যাডাম আছেন। বড় আপা সেরিনাকে ডেকে একেবারে তার নিজের কাছে নিয়ে গেলেন, তার মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে বুকের মাঝে একটু জড়িয়ে ধরলেন, তারপর বললেন, “সেরিনা, মা, তোমাকে যে আমি কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝতে পারছি না। তুমি না থাকলে কী সর্বনাশ যে হয়ে যেতো, চিন্তা করলেই আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
সেরিনা কিছু বলল না। বড় আপা বললেন, “সবাই যেটা বলছে সেটা বিশ্বাস করার মতো না, কিন্তু এতোজন মানুষের সামনে পুরো ব্যাপারটা ঘটেছে আমি ব্যাপারটা অবিশ্বাস করি কেমন করে? তুমি এতো ভালো সতার দেয়া কেমন করে শিখলে?”
সেরিনা আমতা আমতা করে বলল, “এইতো মানে ইয়ে—“
“আমরা ঠিক করেছি স্কুলের পক্ষ থেকে আমরা তোমাকে একটা পুরস্কার দেব। অ্যানুয়েল স্পোর্টসের দিনে তোমাকে সেই পুরস্কার দেওয়া হবে।”
সেরিনা শুকনো গলায় বলল, “থ্যাংক ইউ ম্যাডাম।”
নাজমা ম্যাডাম বড় আপাকে বললেন, “আপা, আপনি তো আসল কথাটাই বললেন না।”
বড় আপা বললেন, “আপনি বলেন।”
নাজমা ম্যাডাম তখন তার খনখনে গলায় সেরিনাকে বললেন, “তুমি এতো ভালো সাঁতার জানো কিন্তু তুমি আমাদের সাঁতার প্রতিযোগিতায় যোগ দিলে না কেন?”
সেরিনা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, সে এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে?
“যাই হোক, আমরা ঠিক করেছি তুমি প্রতিযোগিতায় যোগ না দিলেও তোমাকে আমাদের টিমে নিয়ে নেব। ন্যাশনাল কয়েকটা ইভেন্ট আছে সেইখানে আমরা অংশ নেব। তুমি হবে আমাদের টিম লিডার।”
সেরিনা ভয় পাওয়া গলায় বলল, “না!”
“কেন না? তুমি এতো ভালো সাঁতার জান, তুমি কেন অংশ নেবে।”
সেরিনা কী উত্তর দিবে বুঝতে পারল না, আমতা আমতা করে বলল, “না ম্যাডাম না। আমি পারব না।”
“তুমি কী পারবে না?”
“আমি সাঁতারের টিমে থাকতে পারব না।”
“কেন পারবে না?”
সেরিনার কোনো ভালো উত্তর নেই, তাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। বড় আপা জিজ্ঞেস করলেন, “কেন পারবে না?”
সেরিনা অসহায় ভাবে বলল, “আমার আব্বু বলেছে আমি যেন কোথাও না যাই।”
বড় আপা হাসি মুখে বললেন, “এই সমস্যা? আমি নিজে তোমার আব্বুর সাথে কথা বলে পারমিশন নিব তুমি নিশ্চিন্ত থাক।”
.
সত্যি সত্যি বড় আপা নাজমা ম্যাডামকে নিয়ে একদিন বাসায় হাজির হয়ে গেলেন। শামীমের তখন আর কিছু বলার থাকল না।
০৫. বাস থেকে নেমে সেরিনা
বাস থেকে নেমে সেরিনা তার ব্যাগটা ঘাড়ে তুলে নিল। নার্গিস তার ব্যাগটা নিয়ে সেরিনার পাশে দাঁড়াল। জেলেপাড়ার দুটি মেয়ে গৌরি আর ললিতা তাদের ব্যাগ খুঁজে পাচ্ছিল না, শেষ পর্যন্ত তারাও তাদের ব্যাগ খুঁজে পেল তখন চারজন তাদের ব্যাগ নিয়ে নাজমা ম্যাডামের পিছু পিছু সিঁড়ি দিয়ে বিল্ডিংটার উপরে উঠে যায়। এটা মেয়েদের একটা হোস্টেলে মত, সারা দেশ থেকে সাঁতার প্রতিযোগিতায় যে ।এসেছে তারা আগামী কয়েকদিন এখানে থাকবে।
কালো মতন মোটা একজন মানুষ সবাইকে তাদের রুম নম্বর বলে দিচ্ছে। নাজমা ম্যাডাম মানুষটার কাছে থেকে সেরিনাদের রুম নম্বর জেনে নিলেন তারপর তাদেরকে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেলেন, একেবারে একটা কোনার দিকে একটা বড় ঘর, সেখানে অনেকগুলো বিছানা সারি সারি সাজানো। নাজমা ম্যাডাম বললেন, “তোমরা তোমাদের পছন্দের বিছানা বেছে নাও। আর কেউ যখন এখনো আসে নি তোমাদের ফার্স্ট চয়েস।“
নাজমা ম্যাডামের কথা শুনে মনে হল এটা বুঝি বিশাল একটা সুযোগ–আসলে সবগুলো বিছানা একই রকম, কাজেই আগে আর পরে বেছে নেওয়ার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। নার্গিস কোনার দিকে জানালার পাশে একটা বিছানার দিকে গিয়ে বলল, “এইটা আমার বিছানা।” তখন কাছাকাছি অন্য তিনটা বিছানা বাকী তিনজন দখল করে নিল।
নাজমা ম্যাডাম বললেন “করিডোরের অন্য মাথায় বাথরুম আছে। নিচে ডাইনিং রুম।”
সেরিনা বলল, “ঠিক আছে ম্যাডাম।”
“টিচারদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। আমাদেরকে অন্য বিল্ডিংয়ে রাখবে। তোমরা নিজেরা নিজেরা থাকতে পারবে না?”
মেয়েরা মাথা নাড়ল, সেরিনা বলল, “পারব।”
“গুড। আমি তাহলে যাই, গিয়ে দেখি আমাদের জন্যে কী ব্যবস্থা করেছে।”
নাজমা ম্যাডাম চলে যাবার পর সেরিনা তার বিছানায় বসে বলল, “আমার খিদে লেগেছে।”