পানি ছিটিয়ে সাঁতার কেটে একে একে সবগুলো মেয়ে বাঁশ পর্যন্ত পৌঁছাল তখন তাদেরকে পুকুর পাড়ে নিয়ে এসে কে প্রথম কে দ্বিতীয় হয়েছে নাজমা ম্যাডাম তাদের নাম লিখে নিতে শুরু করল।
যখন সবাই পুকুরের এই পাড়ে সাঁতার প্রতিযোগিতার জন্যে ভিড় করেছে তখন পুকুরের অন্য পাড়ে একটা বিপদজনক ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। নিচু ক্লাশের ছোট একটা মেয়ে পুকুরের অন্য পাড়ে একা একা নিজের মতো করে হেঁটে বেড়াচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে পুকুরের মাঝে কিছু একটা দেখে দাঁড়িয়ে গেল। যেটা দেখে সে দাঁড়িয়েছে সেটা নিশ্চয়ই তার জন্যে যথেষ্ট কৌতূহলী কিছু, কারণ দেখা গেল সে ধীরে ধীরে পুকুরের পানির দিকে নামতে শুরু করেছে। পানির খুব কাছাকাছি এসে সে নিচু হয়ে পুকুর থেকে কিছু একটা তোলার চেষ্টা করতে থাকে এবং ঠিক তখন পুকুরের অন্য পাড় থেকে কেউ একজন প্রথমবার তাকে দেখতে পায়।
উঁচু ক্লাশের বড় একটা মেয়ে চিৎকার করে বলল, “এই মেয়ে? তুমি কী কর? পানিতে পড়ে যাবে তো?”
মেয়েটি তখন সত্যি সত্যি পানিতে পড়ে গেল। সবাই দেখল মেয়েটি পানিতে একটু হাবুডুবু খেলো তারপর পানিতে তলিয়ে গেল। পুকুরের পানিতে ছোট মেয়েটির কোনো চিহ্ন নেই।
এক সাথে সবাই চিৎকার করে ওঠে, কয়েক মুহূর্ত কেউ কে কী করবে ঠিক করে বুঝতে পারে না। তারপর সবাই পুকুরের তীর ধরে দৌড়াতে শুরু করে। বিশাল পুকুর, এক পাশ থেকে দৌড়ে অন্য পাশে যেতে সময় লাগবে। পুকুরের অন্য পাশে পৌঁছানোর পরেও কেউ বাচ্চাটাকে তোলার জন্যে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে না, মাছ চাষিরা পুকুরের চারপাশে গাছের ডাল, বাঁশ পুঁতে রেখেছে। মেয়েদের আতংকিত চিৎকারে মুহূর্তে পুরো এলাকাটা ভয়ংকর হয়ে উঠে।
সেরিনা এক মুহূর্ত চিন্তা করল, আর আব্বু অসংখ্যবার তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে কেউ যেন পানির নিচে নিশ্বাস নেবার বিস্ময়কর ক্ষমতার কথা জানতে না পারে। সে কখনো কাউকে জানায় নি, কিন্তু সে এখন নিজের চোখের সামনে একটা বাচ্চাকে পানির নিচে নিশ্বাস নিতে না পেরে মারা যেতে দিতে পারবে না।
তাই সবাই অবাক হয়ে দেখল হঠাৎ সেরিনা পুকুরের তীর ধরে ছুটে এসে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পুকুরের পানিতে এতোটুকু ঢেউ না তুলে একটা তীরের মতো তার পুরো শরীরটা পানির ভেতর ঢুকে গেল। তারপর কোথাও কিছু নেই, একটা নিস্তরঙ্গ পুকুর, তার নিচে কী আছে কেউ জানে না।
দুই হাতে পানি কেটে সেরিনা সামনে এগিয়ে যায়, অসংখ্য বড় বড় মাছ সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দেয়, ঘোলা পানি আর শ্যাওলা, বেশি দূর দেখা যায় না। তার মাঝে সেরিনা দ্রুত এগিয়ে গেল। পরিষ্কার কিছু দেখা না গেলেও পানির ভেতর সে ছটফট করে নাড়াচাড়া করার শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
চোখের পলকে সে শিশুটির কাছে পৌঁছে গেল, পানির নিচে গাছের ডালের সাথে তার কাপড় আটকে গেছে সেখান থেকে ছুটতে পারলেও সে ভেসে উঠতে পারবে না। এই বাচ্চাটি সাঁতার জানে না।
বাচ্চাটির বুকের ভেতর বাতাস দরকার। সেরিনা বাচ্চাটির নাক চেপে ধরে মুখের ভেতর ফুঁ দিয়ে খানিকটা বাতাস ঢুকিয়ে দেয়। তারপর কাপড়টি হঁচকা টানে ছুটিয়ে আনে। বাচ্চাটি পাগলের মতো সেরিনাকে জাপটে ধরল, অন্য কেউ হলে সেটা বড় সমস্যা হয়ে যেতো, সেরিনার জন্যে কোনো সমস্যা নয়, সে পানির নিচে যতক্ষণ খুশী যেভাবে ইচ্ছে থাকতে পারে। কিন্তু বাচ্চাটি যেন নিজে থেকে নিশ্বাস নিতে পারে সেজন্যে তাকে ওপরে তুলতে হবে। সেরিনা পায়ে ধাক্কা দিয়ে মুহূর্তে পানির ওপর ভেসে উঠল, আর সাথে সাথে পুকুর ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য ছাত্রী, শিক্ষক আনন্দে চিৎকার করে উঠল।
ঘোট শিশুটি খক খক করে কাশছে, বুকের ভেতর মনে হয় পানি ঢুকে গেছে কিন্তু সেটা নিয়ে সেরিনা মাথা ঘামলি না, বাচ্চাটার মাথায় হাত দিয়ে বলল, “ভয় নাই, তোমার কোনো ভয় নাই।”
বাচ্চাটা পাগলের মতো তাকে জাপটে ধরে রেখেছে, ভয়ে আতংকে থর থর করে কাঁপছে, তার মনে হচ্ছে সেরিনাকে ছেড়ে দিলেই বুঝি সে আবার ডুবে যাবে।
সেরিনা বাচ্চাটিকে পিঠে নিয়ে সাঁতার কেটে পুকুর পাড়ে হাজির হতেই একসাথে অনেক মেয়ে বাচ্চাটাকে ধরে উপরে তুলে আনে। বাচ্চাটি আতংকিত মুখে কাশতে থাকে, হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে।
সেরিনা নিজেও উপরে উঠে আসে আর সবাই তাকে ঘিরে ধরে। তার ক্লাশের একটি মেয়ে সেরিনাকে জাপটে ধরে কেঁদে ফেলল, বলল, “তুই কেমন করে করলি? কেমন করে করলি?”
সেরিনা হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমাকে ছাড়, তুই ভিজে যাচ্ছিস।”
“ভিজলে ভিজব। তুই এতো ভালো সাঁতার কাটতে পারিস?”
সেরিনা উত্তর দিল না, আরেকজন বলল, “তুই নিশ্বাস না নিয়ে পানির নিচে এতোক্ষণ কেমন করে থাকতে পারলি? কেমন করে?”
সেরিনা এবারেও কোনো উত্তর দিল না। আরেকজন বলল, “তুই না থাকলে বাচ্চাটা আজকে নির্ঘাত মরে যেতো। নির্ঘাত মরে যেতো।”
সেরিনা এবারেও কোনো কথা বলল না।
.
রাত্রিবেলা খাবার টেবিলে সেরিনা বলল, “আব্বু, আমার কিছু করার ছিল না।”
শামীম বলল, “অবশ্যই তোর কিছু করার ছিল না। তুই ছাড়া আর কেউ এই বাচ্চা মেয়েটাকে বাঁচাতে পারতো না।”
“কিন্তু এখন সবাই জেনে গেছে।”
“কী জেনে গেছে?”
“আমি পানির নিচে থাকতে পারি।“