শামীম তখন সেই ভয়ংকর ঘটনার একটা শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনা দিল। সে কীভাবে তার স্পিড বোট নিয়ে সেখানে হাজির হল, তারপর কীভাবে দেখল প্রাণহীন বাবা কীভাবে তার প্রাণহীন স্ত্রীকে ধরে রেখেছে, আর তাদের দুজনের মাঝখানে ছোট একটা শিশু কীভাবে পানিতে ভেসে আছে। তখন শিশুটি ঠিক মাছের মতো সাঁতরে তার কাছে এসেছে, তার দৃষ্টি কী বিস্ময়কর অবাক হয়ে এই পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে। সেই ছোট শিশুটি হচ্ছে সেরিনা।
কাল্পনিক গল্প। বলতে গিয়ে শামীমের গলা ধরে আসে। শুনতে শুনতে সেরিনার চোখ ভিজে আসে।
» ০৪. স্কুলের এসেমব্লিতে বড় আপা
স্কুলের এসেমব্লিতে বড় আপা লম্বা বক্তৃতা দিতে ভালোবাসেন। এই দেশের মেয়েরা কীভাবে পুরো দেশটাকে পাল্টে দেবে সেটা তার প্রিয় একটা বিষয়। প্রত্যেকদিনই রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে স্কুলের মেয়েদের এই লম্বা বক্তৃতা শুনতে হয়। বড় আপা একেকদিন একেকজন বিখ্যাত মহিলা নিয়ে বক্তৃতা দেন। আজকে কাকে নিয়ে বক্তৃতা দেবেন সেটা জানার জন্যে যখন সবাই এক ধরণের কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছে তখন বড় আপা বললেন, “প্রিয় মেয়েরা। আর দুই সপ্তাহ পরে স্কুল স্পোর্টস। ক্রীড়া প্রতিযোগিতা!”
লেখাপড়া ছাড়া অন্য সবকিছুতে মেয়েদের উৎসাহ, তাই সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল। বড় আপা বললেন, “লেখাপড়ার পাশাপাশি দরকার খেলাধূলা। সুস্থ মন থাকতে পারে শুধু সুস্থ শরীরে। তোমাদের যেন সুস্থ শরীর, সুস্থ দেহ থাকে সেজন্যে আমরা ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করি। এই বছর দৌড় ঝাপের সাথে একটা নতুন বিষয় যোগ হচ্ছে যেটা আগে কখনো হয় নি। সেটা হচ্ছে–” বলে বড় আপা একটু থামলেন, সব মেয়েরা এই নূতন বিষয়টা শোনার জন্যে কান পেতে রইল।
বড় আপা তখন হাত তুলে ঘোষণা করলেন, “সাঁতার।”
মেয়েরা শুনে খুব চমৎকৃত না হলেও চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করল। বড় আপা জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কারা কারা সাঁতার জানো?”
সবাই হাত তুলল। শুধু ছোট ক্লাশের কয়েকটা মেয়ে হাত তুলল না। তারা হয় সাঁতার জানে না, না হয় বড় আপা কী বলছেন সেটা বুঝতে পারে নি। গ্রামের প্রায় সব মেয়ে বড় হতে হতে সাঁতার শিখে যায়। সেরিনা ইচ্ছে করে হাত তুলে নি, পানির সাথে তার যে একটা বাড়াবাড়ি বন্ধুত্ব আছে সেটা সে সব সময় গোপন রাখার চেষ্টা করে তাই সে নিজে থেকে এটা কাউকে বলে না।
বড় আপা বললেন, “সরকার থেকে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখন থেকে প্রতি বছর মেয়েদের সাঁতার প্রতিযোগিতা হবে। আমাদের স্কুল থেকেও আমরা টিম পাঠাব। তোমরা কারা কারা অংশ নিতে চাও?”
এবারেও প্রায় সব মেয়ে হাত তুলল, সেরিনা এবারও হাত তুলল না। সে কোনো সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে চায় না। বড় আপা বললেন, “তোমরা যারা সাঁতার প্রতিযোগিতায় নাম দিতে চাও তারা নাজমা ম্যাডামের কাছে নাম দিবে।” নাজমা ম্যাডাম স্কুলের স্পোর্টস টিচার, শুকনো, খিটখিটে এবং বদরাগী। বড় আপা বললেন, “আর তোমরা যারা দৌড় ঝাপে নাম দিতে চাও তারা ক্লাশ টিচারের কাছে নাম দিবে।”
স্কুলে বার্ষিক প্রতিযোগিতার জন্যে প্রতিদিন দুপুরের পর ক্লাশ ছুটি দিয়ে দেয়া হল। মেয়েরা তখন স্কুলের মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে। হাই জাম্প, লং জাম্প দেয়। যারা কখনো দৌড়াদৌড়ি করে না তারা আছাড় খেয়ে পড়ে হাঁটু আর কনুইয়ের ছাল তুলে ফেলতে লাগল। সাঁতার নিয়ে বড় আপার অনেক বক্তৃতা দেবার পরেও খুব বেশী মেয়ের সাঁতারে উৎসাহ দেখা গেল না জেলেপাড়ার দুটি মেয়ে আর ডানপিটে ধরণের কয়েকটা মেয়ে ছাড়া সাঁতার প্রতিযোগিতায় বেশী মেয়ে পাওয়া গেল না।
স্কুলের সীমানার ভেতরে একটা পুকুর রয়েছে, বহু বছর আগে একটা মেয়ে ডুবে মারা যাবার পর এখন কাউকে সেখানে যেতে দেয়া হয় না। স্কুলের সবচেয়ে দুষ্টু মেয়েটিও পুকুরের কাছে যেতে সাহস পায় না। স্কুল কর্তৃপক্ষ পুকুরে মাছের চাষ করে, বাইরের লোকজন এই পুকুর লিজ নিতে খুবই আগ্রহী, তার প্রধান কারণ মেয়েদের স্কুল বলে কেউ মাছ চুরি করে নেবে সেরকম ভয় নেই।
সাঁতার প্রতিযোগিতার জন্যে পুকুরের এক পাশের জঞ্জাল পরিষ্কার করা হয়েছে। মেয়েরা এক পাশ থেকে অন্য পাশে সাঁতরে যাবে। আগে থেকে এই প্রতিযোগিতাটি সেরে রাখা হচ্ছে, মূল স্পোর্টসের দিনে শুধু পুরস্কার দেয়া হবে। নাজমা ম্যাডাম প্রত্যেকদিন শাড়ি পরে স্কুলে আসেন, আজকে সাঁতার প্রতিযোগিতার জন্যে সালওয়ার কামিজ পরে এসেছেন। নিজে পুকুরে নেমে মেয়েগুলোকে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিলেন। পুকুরের মাঝামাঝি একটা বাঁশ ভাসিয়ে রাখা হয়েছে, মেয়েগুলো সঁতরে এসে এই বাঁশটাকে ছুঁবে, কে আগে ছুঁয়েছে কে পরে ছুঁয়েছে সেখান থেকে প্রথম দ্বিতীয় ঠিক করা হবে।
সাঁতার প্রতিযোগিতা দেখার জন্যে স্কুলের অনেক ছাত্রী পুকুর পাড়ে হাজির হয়েছে। তাদের মাঝে সেরিনাও আছে। নাজমা ম্যাডাম প্রথমে সবাইকে বলে দিলেন কী করতে হবে। একবার বাঁশী বাজিয়ে প্র্যাকটিস করা হল। তারপর যারা সাঁতার দেবে তারা পুকুর পাড়ে সারি বেঁধে দাঁড়াল। নাজমা ম্যাডাম বাঁশী বাজাতেই সবাই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণপণে সাঁতার দিতে শুরু করল। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে সবাই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে, গৌরী আর ললিতা নামে জেলে পাড়ার দুটি মেয়ে সবার আগে, তার কিছু পিছনে নার্গিস নামে একজন ডানপিটে মেয়ে। অন্যেরা অনেক পিছনে।