অশুন মুখে শ্লেষের হাসি ফুটিয়ে বলল, আর যদি ঠিক তার উল্টো হয়? যদি দেখা যায় সবাই পুরুষ মহিলা বলে কিছু নেই এবং তোমাকেই যদি উলঙ্গ করে চিড়িয়াখানায় রেখে দেয়?
নিশি মুখে বিচিত্র একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, সেটাই যদি তুমি বিশ্বাস কর তা হলে আমার চ্যালেঞ্জটুকু গ্রহণ করার সাহস তোমার নেই কেন?
কে বলেছে সাহস নেই?
তা হলে আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ কর।
অশুন কঠোর মুখে বলল, অবশ্যই গ্রহণ করব। কেন গ্রহণ করব জান?
কেন?
যখন আমরা হিমঘর থেকে বের হয়ে আসব, তখন তোমাকে যেভাবে টেনেহিচড়ে ধ্বংস করে প্রকৃতিকে ত্রুটিমুক্ত করবে সেই দৃশাটি দেখার জন্য। এই দৃশ্যটি দেখে আমি যে আনন্দ পাব পৃথিবীর আর কেউ সে আনন্দ কোনো দিন পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
নিশি মাথা নাড়ল। বলল, আমি তোমার মনের ভাবটি ঠিক ঠিক বুঝতে পারছি অশুন। আমি ঠিক জানি তুমি কী ভাবছ—কারণ আমিও ঠিক একই জিনিস ভাবছি। তোমাকে ধ্বংস হতে দেখার চাইতে বেশি আনন্দ পৃথিবীতে আর কিছুতে নেই। এই পরিচিত জগৎ থেকে এক হাজার বছর ভবিষ্যতের অনিশ্চিত জ্বগতে যেতে আমার কোনো দ্বিধা নেই শুধু এই একটি কারণে, আমি এই তীব্র আনন্দটুকু পেতে চাই। এই আনন্দটুকুর জন্য আমি সবকিছু দিতে পারি।
চমৎকার।
নিশি শীতল গলায় বলল, তুমি তা হলে আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলে?
হ্যাঁ করছি।
নিশি এবং অশুন একজন আরেক জনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সেই দৃষ্টিতে এত ভয়ংকর ঘৃণা প্রকাশ পেতে থাকে যে নিজের অজান্তেই দুজনের বুক কেঁপে ওঠে।
* * * * *
স্টিল ভন্টের দরজা খুলে নিশি এবং অশুন হিমঘর থেকে বের হয়ে এল। পৃথিবীতে এর মাঝে এক হাজার বছর পার হয়ে গেছে, যদিও এই দুজনের কাছে মনে হচ্ছে মাত্র কিছুক্ষণ আগে তারা এর মাঝে প্রবেশ করেছে।
নিশি অণ্ডনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী আশ্চর্য! আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে তোমার মতো একটি নর্দমার কীটের সাথে আমি এক হাজার বছর কাটিয়ে দিয়েছি!
হ্যাঁ। অশুন একটি নিশ্বাস ফেলে বলল, ভাগ্যিস আমার দেহ কয়েক ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায় ছিল, তোমার কাছে অচেতন না হয়ে থাকার কথা কল্পনা করা যায়?
নিশি ছটফট করে বলল, আমার আর অপেক্ষা করার ধৈর্য নেই। আমি এই মুহূর্তে বের হয়ে যেতে চাই। দেখতে চাই পৃথিবীতে শুধু মেয়ে আর মেয়ে। আমি চাই তারা মুহূর্তে তোমাকে ধরে নিয়ে যাক, তোমাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলুক।
হ্যাঁ। অশুন মাথা নেড়ে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। আমিও আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আমরা যখন বের হব তারপর আর হয়তো তোমার সাথে দেখা হবে না। তোমাকে শেষ একটি কথা বলে যাই।
কী কথা?
তোমাকে যখন ধ্বংস করতে নিয়ে যাবে তখন তুমি একটি জিনিস ভেবে আনন্দ পাবার চেষ্টা করো।
নিশি জিজ্ঞেস করল, কী জিনিস?
তোমার মৃত্যুটি আমাকে অপূর্ব এক ধরনের আনন্দ দেবে। অচিন্তনীয় আনন্দ। তোমার কারণে আমি এই আনন্দটি পেতে পেরেছি।
সেটি নিয়ে কথা না বলে পরীক্ষা করেই দেখা যাক। চল আমরা বাইরে যাই। মানুষ খুঁজে বের করি।
হ্যাঁ চল। অশুন বলল, আর কিছুক্ষণ পর তোমাকে আর কখনোই দেখতে হবে না ব্যাপারটি চিন্তা করেই আনন্দে আমার নাচতে ইচ্ছে করছে।
নিশি মুচকি হেসে বলল, দেখা যাক কে সত্যিই নাচে।
নিশি এবং অশুন বাইরে এসে আবিষ্কার করল চারপাশের পৃথিবীটি তারা যেরকম কল্পনা করেছিল প্রায় সেভাবেই গড়ে উঠেছে। মানুষ প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ না করে তার সাথে সহাবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে চারপাশে এক ধরনের শান্ত কোমল পরিবেশ বড় বড় গাছ, নির্মেঘ আকাশ, হ্রদে টলটল জলরাশি। তারা যেখানে আছে সেটি একটি বনাঞ্চল। চারপাশে বিচিত্র বুনোফুল, সেখানে প্রজাপতি খেলা করছে। গাছের ডালে পাখির কিচিরমিচির শব্দ, বাতাসে হেমন্তকালের শীতল বাতাসের স্পর্শ।
দুজনে প্রায় আধাঘণ্টা হেঁটে প্রথমবার একটি লোকালয়কে খুঁজে পেল। ছবির মতো সুন্দর বাসার সামনে নানা বয়সী মানুষ একটি আনন্দমুখর পরিবেশে হইচই করছে। নিশি এবং অশুন নিশ্বাস বন্ধ করে মানুষগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। প্রথমে একটি শিশু তাদের দেখে হঠাৎ আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকে এবং অন্যরা তাদের দিকে এগিয়ে আসে, কিছুক্ষণের মাঝেই নানা বয়সী মানুষ এক ধরনের বিস্ময়াভিভূত চোখ নিয়ে তাদের ঘিরে পাড়ায়। নিশি এবং অশুন মানুষগুলোর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করে এরা কি পুরুষ নাকি নারী? কিন্তু তারা বুঝতে পারে না। মানুষগুলো অবোধ্য ভাষায় কথা বলছে, তারা কিছু বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণের মাঝেই একজন একটি ভাষা অনুবাদক যন্ত্র নিয়ে আসে। মধ্যবয়স্ক মানুষটি সেটি মুখে লাগিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কী? তোমরা কোথা থেকে এসেছ?
নিশি এবং অন একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, এটি কী ধরনের প্রশ্ন? অন বলল, আমরা মানুষ। আমরা সুদূর অতীত থেকে এসেছি।
কী আশ্চর্য! কম বয়সী একজন আশ্চর্যধ্বনি করে বলল, তোমরা দুজন দেখতে দুরকম কেন?
নিশি এবং অশুন এই প্রথমবারের মতো নিজেদের ভেতর সূক্ষ্ম এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। নিশি কঁপা গলায় বলল, আমরা দুজন দেখতে দুরকম কারণ আমাদের একজন নারী অন্যজন পুরুষ।
নিশির কথা শুনে আতঙ্কের একটা শব্দ করে সবাই এক পা পিছিয়ে যায়। মানুষগুলো ফিসফিস করে ভয় পাওয়া গলায় বলে, সর্বনাশ! পুরুষ নারী!