সায়রা কাছাকাছি রাখা একটা মাইক্রোফোন টেনে নিয়ে বলল, হ্যাঁলো বিল্টু-আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?
স্পিকারে বিল্টুর কথা শুনতে পেলাম। শুনতে পাচ্ছি। রজার।
তোমার সামনে দশ ফুট গিয়ে ডানদিকে চার ফুট গেলে জরিনিকে পাবে।
টু ও ক্লক পজিশন?
রজার। টু ও ক্লক।
আমি সায়রার দিকে তাকিয়ে বললাম, টু ও ক্লক? মানে কী?
ঘরটাকে একটা ঘড়ির মতো চিন্তা করেন–ঠিক সামনে হচ্ছে বারোটা। দুইটা মানে হচ্ছে একটু সামনে একটু ডানে। বুঝেছেন?
আমি কিছু বুঝলাম না কিন্তু সেটা বলতে লজ্জা লাগল, তাই জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললাম, বুঝেছি। বুঝেছি।
সায়রা মাইক্রোফোনে বলল, বিল্টু। ডানদিকে সোফার নিচে লুকিয়ে আছে। ডাইভ দাও।
আমরা স্ক্রিনে দেখতে পেলাম সবুজ বিন্দুটা একটু ডাইভ দিল কিন্তু লাল বিন্দুটা তিন লাফে সরে স্ক্রিনের কোনায় চলে এল। সায়রা বলল, বিল্টু জরিনি এখন ফাইত ও ক্লক পজিশনে।
এইটার মানে কী আমি বুঝতে পারলাম না কিন্তু বিল্টু ঠিকই বুঝল, দেখলাম সবুজ বিন্দুটা আবার লাল বিন্দুটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লাভ হল না–জরিনি মহা ধুরন্ধর। ঠিক শেষ মুহূর্তে লাফিয়ে সরে গেল।
প্রায় আধঘণ্টা এরকম লুকোচুরি খেলা হল। আমি যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছি তখন হঠাৎ করে শুনতে পেলাম সায়রা দাঁতের ফাঁক দিয়ে আনন্দের একটা শব্দ করল। আমি বললাম, কী হয়েছে?
এবারে বাছাধন আটকা পড়েছে।
আটকা পড়েছে?
হ্যাঁ–এখান থেকে পালানোর জায়গা নেই। যাকে বলে একেবারে অন্ধ গলি! সায়রা মাইক্রোফোনে মুখ লাগিয়ে বলল, বিল্টু! এইবারে আটকানো গিয়েছে।
রজার।
টুয়েলভ ও ক্লক। শার্প।
রজার।
উবু হয়ে ঢুকে যাও। ছয় ফুট দূর থেকে শুট কর।
বিল্টু খানিকক্ষণ পর উত্তর করল, ভিতরে অন্ধকার।
তোমার কোমরে সুইচ আছে। জ্বালিয়ে নাও।
বিল্টু নিশ্চয়ই জ্বালিয়ে নিল, কারণ শুনতে পেলাম সে বলছে, এবারে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
জরিনিকে দেখেছ?
দেখেছি।
শুট কর।
আমরা কন্ট্রোলরুমে বসে একটা বজ্রপাতের মতো শব্দ শুনতে পেলাম। সায়রা নিশ্বাস আটকে রেখে বলল, ঘায়েল হয়েছে? হয়েছে?
বুঝতে পারছি না।
আমরা দেখতে পেলাম জরিনির লাল বিন্দুটি একই জায়গায় আছে-বির সবুজ বিন্দু এগিয়ে যাচ্ছে। দুটি খুব কাছাকাছি চলে এল–আবার বজ্রপাতের মতো শব্দ হল। লাল বিন্দুটি কয়েকবার কেঁপে উঠল। সায়রা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, এবারে একেবারে শেষ! বাঁচার কোনো উপায়ই নেই।
আমরা দেখতে পেলাম লাল বিন্দু এবং সবুজ বিন্দু খুব কাছাকাছি। সায়রা মাইক্রোফোনে জিজ্ঞেস করল, কী অবস্থা বিল্টু?
বিল্টু কোনো উত্তর করল না। সায়রা আবার জিজ্ঞেস করল, বিল্টু কী অবস্থা?
বিল্টু এবারেও কোনো উত্তর করল না। শুধু দেখলাম লাল বিন্দু এবং সবুজ বিন্দু খুব কাছাকাছি। সায়রা একটু দুশ্চিন্তিত হয়ে ডাকল, বিল্টু। তুমি ঠিক আছ তো?
জি ঠিক আছি।
মিশন কমপ্লিট?
কমপ্লিট। জরিনি ছ্যাড়াবেড়া হয়ে গেছে। কানের সাথে একটা রিং ছিল শুধু সেটা আছে। আর কিছু নাই।
সায়রা জিব দিয়ে চুকচুক শব্দ করে বলল, হাইভোল্টেজে ভস্মীভূত হয়ে গেছে শুধু মাইক্রোওয়েভ ট্যাগটা আছে।
বিল্টু জানতে চাইল, ওটা কি নিয়ে আসব?
হ্যাঁ নিয়ে এস। সায়রা হঠাৎ একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।
কিছুক্ষণের মাঝেই বিল্টু ফিরে এল। যদিও বুঝতে পারছিলাম এরকম বুদ্ধিমান নেংটি ইঁদুর ছাড়া পেয়ে যাওয়া পৃথিবীর জন্য খুব বড় বিপদের ব্যাপার। তারপরেও এরকম চালাক-চতুর ইঁদুরটা এভাবে মারা গেল চিন্তা করে আমার খুব খারাপ লাগছিল। বিদঘুটে অস্ত্র হাতে ইঁদুরকে মেরে ফেলা আমার কাছে মানুষ মেরে ফেলার মতো বড় অপরাধ মনে হতে লাগল। আমি সায়রার মুখের দিকে তাকালাম-এত বড় একটা বিপদ থেকে সারা পৃথিবী রক্ষা পেয়েছে কিন্তু তার মুখে এখন আর সেরকম আনন্দ দেখা যাচ্ছে না। শুধু বিল্টুর চোখে-মুখে ঝলমলে আনন্দ–ছোট বাচ্চারা মনে হয় একটু নিষ্ঠুর হয়।
পরিবেশটা কেমন জানি ভার ভার হয়ে রইল। জরিনির কানে যে রিংটা ছিল সায়রা অনেকক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জরিনি বেটি মাপ করে দিস আমাকে। আমি দেখলাম সায়রার চোখ ছলছল করছে।
আমি আর বিল্টু যখন সায়রার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসছি তখন হঠাৎ করে বিল্টু বলল, সায়রা খালা-
উঁ।
আপনি হলুদ রঙের একটা ট্যাবলেট দেখিয়েছেন না– যেটা খেলে ইঁদুরের বাচ্চাকাচ্চা হয় না?
হ্যাঁ। কী হয়েছে সেটার?
আমাকে একটা ট্যাবলেট দেবেন?
কেন কী করবে?
আমাদের বাসায় কয়দিন থেকে খুব ইঁদুরের উৎপাত। এটা ফেলে রাখব-ইঁদুর খেয়ে ফ্যামিলি প্ল্যানিং করবে। আর ইঁদুরের বাচ্চা হবে না।
সায়রা একটা নিশ্বাস ফেলে টেবিলের উপর থেকে একটা কৌটা বের করে একটা ট্যাবলেট বের করে বিল্টুর হাতে দিয়ে বলল, নাও। জরিনির জন্য তৈরি করেছিলাম-সেই যখন নেই এই ট্যাবলেট দিয়ে আমি আর কী করব? সায়রা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল- জরিনির শোকে বেচারি হঠাৎ করে খুব কাতর হয়ে গেছে।
.
আমি আর বিল্টু রিকশা করে যাচ্ছি। রাত সাড়ে আটটার মতো বাজে–নয়টার ভিতরে বাসায় পৌঁছে যাব। রিকশাটা টুকটুক করে যাচ্ছে, বেশ সুন্দর একটা ঝিরঝিরে বাতাস দিচ্ছে। বিল্টু অনেকক্ষণ কোনো কথা বলছে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা বিল্টু, তুই যে এতটুকুন একটা ইঁদুরের বাচ্চাকে এভাবে গুলি করে মারলি তোর খারাপ লাগল না?