আমি মাথা চুলকে বললাম, এটা থামানোর কোনো উপায় নাই?
সায়রা মাথা নাড়ল, বলল, একমাত্র উপায় হচ্ছে জরিনিকে শেষ করে দেওয়া। আর যদি শেষ করা না যায় তা হলে কোনোভাবে তাকে এই ট্যাবলেটটা খাইয়ে দেওয়া। সায়রা ছোট একটা ট্যাবলেট দেখাল, হলুদ রঙের লজেন্সের মতো।
বিল্টু জিজ্ঞেস করল, কী হয় এটা খেলে?
এটা একটা হরমোন ট্যাবলেট। এটা খেলে হরমোনের ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যাবে, আর কখনো বাচ্চা হবে না।
বিল্টু বলল, ইঁদুর এত বড় ট্যাবলেট গিলতে পারবে? গলায় আটকে যাবে না?
এর মাঝে বাদামের গুড়ো, পনিরের টুকরো, মধু আর বিস্কুট মেশানো আছে। ইঁদুর খুব শখ করে খায়। কিন্তু জরিনিকে খাওয়ানোর জন্য ধরতেই পারছি না। জরিনি বেটি মহা ধুরন্ধর।
বিল্টু জিজ্ঞেস করল, এত যদি বুদ্ধিমান তা হলে এই বাসা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে না কেন?
চেষ্টা করছে–পারছে না। পুরো বাসাটা আমি সিল করে রেখেছি। জরিনির কানে একটা রিং লাগানো আছে। সেটা আসলে একটা মাইক্রোচিপ–সেখান থেকে বারো মেগাহার্টজ-এর একটা সিগন্যাল বের হয়। সেই সিগন্যালটা থেকে আমি বুঝতে পারি সে কোথায় আছে। যেমন এই মুহূর্তে সে সার্কিট ব্রেকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে-
কেন?
সায়রার মুখ শক্ত হয়ে উঠল, বলল, নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলব আছে। টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছে এখন নিশ্চয়ই ইলেকট্রিক লাইন কাটবে।
ইলেকট্রিক শক খেয়ে ছাতু হয়ে যাবে।
হবে না। বেটি মহা ধুরন্ধর। একটা পাওয়ার লাইনে ঝুলে ঝুলে কাটে, গ্রাউন্ড থেকে দূরে থাকে।
কথা শেষ হতে না হতেই ঘটাং ঘটাং করে কয়েকটা শব্দ হল এবং হঠাৎ করে ঘরবাড়ি একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। সায়রা পা দাপিয়ে বলল, হতভাগীর কাজ দেখেছেন? কত বড় ধুরন্ধরাসরি আমাকে চ্যালেঞ্জ করছে।
আমি শুকনো গলায় বললাম, এখন কী হবে?
ঐ বেটি চলে ডালে ডালে আমি চলি পাতায় পাতায়। এই রকম একটা কাণ্ড করতে পারে আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল সেই জন্য একটা জেনারেটর রেডি রেখেছি। দুই মিনিটের মাঝেই সেটা চালু হয়ে যাবে।
আমরা আবছা অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে রইলাম, শুনতে পেলাম কুটুর কুটুর শব্দ করে কিছু একটা ঘরের দেওয়ালের ভিতর দিয়ে ছুটোছুটি করছে। নিশ্চয়ই জরিনি-সায়রার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেছে–কী হবে কে জানে? মিনিট দুয়েকের ভিতরে কোথায় জানি শব্দ করে জেনারেটর চালু হয়ে গেল সাথে সাথে ঘরে আলো জ্বলে ওঠে, নানা ধরনের যন্ত্রপাতি গুঞ্জন করতে প্রু করে। সায়রা উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, কী জরিনিং ভেবেছিলি ইলেকট্রিক লাইন কেটে দিবি? এখন?
আমরা শুনতে পেলাম কিচকিচ শব্দ করে ইঁদুরটা কোথায় জানি ছুটে যাচ্ছে। বিল্টু জিজ্ঞেস করল, সায়রা খালা। জরিনি পালাল কেমন করে?
সায়রা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, সেটা আরেক ইতিহাস। জরিনি অনেক কায়দা করে পালিয়েছে।
কী রকম কায়দা?
প্রথমে ভান করল সে অসুস্থ। আস্তে আস্তে হাঁটে। ফেবারিট হিন্দি গান শোনে না। ভালো করে খায় না। শরীর এলিয়ে শুয়ে থাকে। আমি সমস্ত কিছু টেস্ট করে দেখি-কিন্তু কোনো রোগের চিহ্ন পাই না। ভাবলাম ব্যাপারটা হয়তো সাইকোলজিক্যাল। মন ভালো করার জন্য একটা ছোট টেলিভিশন সেট লাগিয়ে দিলাম, সাথে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির ভিডিও। কিন্তু কোনো লাভ হল না। একদিন সকালে উঠে দেখি জরিনি মরে পড়ে আছে। চার পা উপরে তুলে মুখ ভেংচি কেটে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। মুখের কোনায় সাদা ফেনা-চোখ বন্ধ। আমি আর কী করব, গ্লাভস পরে মরা ইঁদুরটাকে বের করে এনেছি। ভাবলাম কেন মারা গেল। সেটা পোস্টমর্টেম করে দেখি। একটা ট্রের উপরে রেখেছি। হঠাৎ করে সে লাফ দিয়ে উঠল তারপর ছুটে শেলফের উপর উঠে গেল- সায়রা থেমে একটা নিশ্বাস ফেলল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কী হল?
আমি পিছনে পিছনে ছুটে গেলাম। সেই বেটি উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে একটা জাইলিনের বোতল আমার উপর ফেলে দিল। এই দেখেন কপালে লেগে কেমন ফুলে উঠেছে-
সায়রা তার মাথাটা আমাদের দিকে এগিয়ে দেয়। আমি এমনি দেখলাম বিটু একটু টিপে দেখল।
সায়রা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তারপর সে শেলফের একেবারে উপরের র্যাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি করে আমাকে ভেংচি কাটতে লাগল। কী বেয়াদবের মতো কাজ আপনি বিশ্বাস করবেন না।
ইঁদুর কেমন করে বেয়াদব হয় আমি বুঝতে পারলাম না কিন্তু এখন এটা জিজ্ঞেস করা মনে হয় ঠিক হবে না। সায়রা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তারপর নিজের লেজটাকে একটা গিটারের মতো ধরে গান গাইতে লাগল-
গান গাইতে লাগল? ইঁদুর গান গাইতে পারে? তার ভাষায় গান :
কিচি কিচি কিচি কিচি ফু
কিচি মিচি কিচি মিচি
মিচি কিচি কু—
এইটা গান?
আমাকে বিরক্ত করার চেষ্টা আর কি! তারপর কী করল আপনি বিশ্বাস করবেন না।
কী করল?
তাকের উপরে ইথাইল অ্যালকোহলের একটা বোতল আছে, সেটা খুলে দুই ঢোক খেয়ে নেশা করে ফেলল।
নেশা?
হ্যাঁ। নেশা করে লাফায়-ঝাপায় ধাক্কা দিয়ে এটা ফেলে দেয়, সেটা ফেলে দেয়। সবচেয়ে ভয়ংকর কাজ কী করল জানেন?
বিল্টু আর আমি একসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, কী?
রান্নাঘর থেকে একটা কাঠি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে জ্বালিয়ে নেয় তারপর সেটাকে মশালের মতো করে ধরে স্লোগান দেয়। মশাল মিছিলের মতো।