পাহাড়ী একটা পথ দিয়ে গর্জন করে লরিগুলো ছুটে যাচ্ছে। বাইরে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে কত রকম অজানা বিপদ গুড়ি মেরে আছে। রুহান জানে আজ রাতে তার চোখে ঘুম আসবে না।
কিন্তু নিজেকে অবাক করে দিয়ে সে একসময় ঘুমে ঢলে পড়ল।
০৩. ঘরঘর শব্দ করে
ঘরঘর শব্দ করে লরির পিছনের দরজাটা খুলে গেল, চোখে রোদ পড়তেই রুহান ধড়মড় করে জেগে ওঠে। একজন মানুষ তার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটাতে। একটা ঝাকুনি দিয়ে চিৎকার করে বলল, নামো সবাই। কোনো সময় নষ্ট করবে না-তাহলে কপালে দুঃখ আছে।
কপালে কী ধরনের দুঃখ থাকতে পারে সেটা নিয়ে কেউ কৌতূহল দেখাল, সবাই হুঁটোপুটি করে নামতে শুরু করল। চারপাশে কংক্রীটের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা বড় একটা জায়গা, ছাড়া ছাড়াভাবে সেখানে কয়েকটা বড় গাছ, গাছে ধূলায় ধূসর বিবর্ণ পাতা। একটু সামনে কংক্রীটের একটা দালান। মাঝামাঝি একটা বড় লোহার দরজা, এ ছাড়া আর কোনো দরজা-জানলা নেই। এরকম কুৎসিত এবং মনখারাপ করা কোনো দালান রুহান আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারল না।
স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে মানুষগুলো সবাইকে ঘিরে রেখে এগিয়ে নিয়ে যায়। কুৎসিত দালানের সামনে পৌঁছতেই লোহার ভারী দরজাটা ঘরঘর শব্দ করে খুলে গেল। কেউ বলে দেয়নি কিন্তু সবাই বুঝে গেল তাদের এখন ভেতরে ঢুকতে হবে। রুহান ভেতরে পা দেবার আগে একবার পিছন ফিরে তাকাল। তার কেন জানি মনে হলো একবার ভেতরে ঢুকে গেলে তার জীবনটা একেবারেই পাল্টে যাবে। সেই জীবন থেকে আর কখনোই সে আর ফিরে আসতে পারবে না।
লম্বা একটা করিডোর ধরে তারা এগিয়ে যায়। মাঝখানে একটা বড় হলঘরের মতো, সেখানে উঁচু ছাদ থেকে হলদে এক ধরনের আলো ঝুলছে। কংক্রীটের ধূসর দেয়াল, পাথরের অমসৃণ মেঝে। হলঘরের মাঝামাঝি কঠোর চেহারার একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা ঝাঁকিয়ে সে বলল, তোমাদের এক ঘণ্টা সময় দেয়া হলো প্রস্তুত হবার জন্যে। এর মাঝে তোমরা তোমাদের নোংরা পোশাক খুলে গরম পানি দিয়ে গোসল করো। টিবিলে গরম স্যুপ, মাংসের স্টু আর রুটি রাখা আছে-ঝটপট কিছু খেয়ে নাও। তারপর একাডেমীর পোশাক পরে বের হয়ে এসো।
কোথায় বের হয়ে আসবে, তারপর কী করবে এ ধরনের খুঁটিনাটি জিনিস জানার একধরনের কৌতূহল হচ্ছিল কিন্তু রুহান কিছু জিজ্ঞেস করার আগ্রহ পেল না। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে কঠোর চেহারার মানুষটা হলঘরের পিছনের দিকে একটা দরজা দেখিয়ে দেয় এবং সাথে সাথে সবাই হুঁটোপুটি করে সেদিকে ছুটে যেতে শুরু করে।
দরজার কাছাকাছি একজন রুহানের কনুই খামচে ধরল। রুহান মাথা ঘুরিয়ে কিলিকে দেখতে পায়। কিলি ফ্যাকাসে মুখে বলল, রুহান।
কী হয়েছে।
এখন আমাদের কী করবে বলে তোমার মনে হয়?
কেমন করে বলি!
আমাদের কী মেরে ফেলবে বলে মনে হয়?
রুহান হেসে বলল, যদি আমাদের মেরেই ফেলবে, তাহলে এত কষ্ট করে ধরে এনেছে কেন?
হয়তো আমাদের কিডনি, ফুসফুস, লিভার এগুলো কেটেকুটে নেবে।
যদি নিতে চায় নেবে, তার জন্যে আগে থেকে দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই। সময় হলে দেখা যাবে। এখন যেটা করতে বলেছে সেটা করো। গোসল করো, নতুন পোশাক পরে পেট ভরে খাও।
কিলি মাথা নেড়ে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ।
রুহান গলা নামিয়ে বলল, এরা খুব খারাপ মানুষ। তাই সাবধান! আগ শাড়িয়ে কিছু করবে না, নিজে থেকে কিছু করবে না। তারা যেটা বলছে শুধু সেটা করবে। সবার আগে থাকবে না, সবার পিছেও থাকবে না। সবসময় মাঝামাঝি থাকবে। ঠিক আছে?
কিলি মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।
প্রায় ফুটন্ত গরম পানিতে নগ্ন হয় সারা শরীর রগড়ে রগড়ে রুহান গোসল করল। দেয়ালে আলখাল্লার মতো কালো রঙের এক ধরনের পোশাক ঝুলছিল, সেটা পরে নিয়ে সে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। সবাই বুভুক্ষের মতো খাচ্ছে। বিষয়টি কেমন জানি অস্বস্তিকর, এভাবে কাড়াকাড়ি করে খাওয়ার দৃশ্যে এক ধরনের অমানবিক নিষ্ঠুরতা আছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, চোখ সরিয়ে নিতে হয়। রুহান এগিয়ে একটা ছোট বাটিতে খানিকটা স্টু ঢেলে একপাশে সরে দাঁড়াল। তার খুব খিদে পেয়েছে কিন্তু কেন জানি খেতে ইচ্ছে করছে না, মনে হচ্ছে এই পুরো বিষয়টিতে এক ধরনের লজ্জা ও এক ধরনের অসম্মান রয়েছে। রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে পুরো বিষয়টি নিজের ভেতর থেকে সরিয়ে ফেলতে চেষ্টা করে। অন্যমনস্কভাবে শুকনো রুটি ছিঁড়ে স্টুতে ভিজিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করে। বিস্বাদ খাবার, খুব খিদে পেয়েছে তা না হলে এরকম খাবার খেতে পারত কী না সন্দেহ রয়েছে।
খাবার পর সবাই আবার বড় হলঘরটির মাঝে একত্র হলো। হলঘরের মাঝামাঝি বেশ কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তারা সবাইকে সারি করে দাঁড় করাল। তারপর একজন একজন করে সামনে একটা ছোট ঘরে পাঠাতে শুরু করল।
ভেতরের ঘরগুলোতে কী হচ্ছে বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না। রুহান। অনুমান করতে পারে সেখানে সবাইকে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। তাদেরকে ধরে এনেছে বিক্রি করার জন্যে, কার জন্যে কত দাম ধরা হবে সেটা নিশ্চয়ই এখন ঠিক করা হচ্ছে। সেটা কীভাবে ঠিক করা হবে? বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা নেবে? শারীরিক পরীক্ষা নেবে? মানুষকে যখন পণ্য হিসেবে বিক্রি করা হয়, তখন এই পরীক্ষাগুলোর কী কোনো অর্থ আছে? একেবারে সাধারণ একজন মানুষই কী উৎসাহ আর অনুপ্রেরণায় অসাধারণ হয়ে ওঠে না? তাকে যখন পণ্য হিসেবে বেচা-কেনা করা হয় তখন কী তার ভেতরে কোনোভাবে সেই উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা জন্ম নিতে পারে?