কিন্তু কী?
আমার খুব ভয় করছে।
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যখন ভয় পাবার কথা তখন ভয় পেতে হয়। যারা কখনো ভয় পায় না তারা স্বাভাবিক না।
কিলি বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না। পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে লরিগুলো সারি বেঁধে ছুটে চলেছে। চাঁদ ড়ুবে গিয়ে বাইরে অন্ধকার। শরতের শেষ রাতের হিমেল বাতাসে রহান একটু শিউরে উঠল, এভাবে ধরে নিয়ে যাবে জানলে সে নিশ্চয়ই একটা গরম জ্যাকেট পরে আসত।
কিলি আবার গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, রুহান।
বলো।
ওরা আমাদের নিয়ে কী করবে বলে তোমার মনে হয়?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, জানি না।
আমাদের অস্ত্র চালানো শেখাবে, যুদ্ধ করতে শেখাবে এটা কী তোমার সত্যি মনে হয়।
হতেও পারে। পৃথিবীতে এখন খুব খারাপ সময়। সব জায়গায় যুদ্ধ হচ্ছে। পৃথিবীতে যুদ্ধ করার মানুষের খুব অভাব।
কিলি একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার খুব অস্থির লাগছে রুহান।
রুহান কিলির ঘাড়ে হাত রেখে বলল, ধৈর্য ধরো কিলি, দেখবে এক সময়। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঠিক এরকম সময়ে হঠাৎ করে চারদিক থেকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। পা ঝুলিয়ে বসে থাকা চারজন অস্ত্র তাক করে উবু হয়ে বসে গেল। একজন চাপা গলায় বলল, সবাই মেঝেতে মাথা নিচু করে শুয়ে থাক। উঠবে না। খবরদার।
রুহান অন্য সবার সাথে মাথা নিচু করে মেঝেতে শুয়ে থাকে। শুনতে পায় তাদের মাথার উপর দিয়ে শিস দেবার মতো শব্দ করে গুলি ছুটে যাচ্ছে। লরিতে বসে থাকা চারজন সশস্ত্র মানুষ ছাড়া ছাড়া ভাবে গুলি করছে, তার শব্দে তাদের কানে তালা লেগে যাবার মতো অবস্থা।
যেভাবে গুলি শুরু হয়েছিল ঠিক সেভাবেই হঠাৎ করে গুলি থেমে গেল। সশস্ত্র মানুষগুলো আবার পা ঝুলিয়ে বসে হালকা গলায় কথা বলতে শুরু করে। তাদের দেখে মনেই হয় না একটু আগে সবাই এত ভয়ঙ্কর গোলাগুলির ভেতর দিয়ে এসেছে। আর সেই ভয়ঙ্কর গোলাগুলিতে যে কেউ মারা পড়তে পারত।
রুহান একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, শোনো। তোমাদের সাথে আমি একটু কথা বলতে পারি।
একজন মাথা ঘুরিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা শক্ত করে ধরে রেখে বলল, কী কথা?
সাধারণ কথা।
মানুষটি কঠিন গলায় বলল, তোমরা ভেতরে এতজন আছ, নিজেদের ভেতরে কথা বল। আমাদের সাথে কেন কথা বলতে চাইছ?
রুহান বলল, ভেতরে যারা আছে এখন তাদের কারো কথা বলার আগ্রহ নেই।
সে খুব একটা মজার কথা বলেছে সেরকম ভাব করে মানুষটা শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, কেন? কথা বলার আগ্রহ নেই কেন?
তোমাদের যদি কেউ মাঝরাতে ঘর থেকে ধরে নিয়ে যেত তাহলে তোমাদেরও কথা বলার কোনো আগ্রহ থাকত না।
পা ঝুলিয়ে বসে থাকা অন্য একজন বলল, এই! এ তো কথাটা মিথ্যা বলে নাই। মনে আছে আমাদের যেদিন ধরে এনেছিল, তখন আমরা কী ভয় পেয়েছিলাম?
রুহান জিজ্ঞেস করল, তোমাদেরকেও ধরে এনেছিল!
ধরে না আনলে কেউ নিজে থেকে আসবে নাকি?
কেন ধরে এনেছিল?
মানুষটা হাত দিয়ে পুরো বিষয়টা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, দুদিন পরে তো নিজেরাই দেখবে। এখন এত কৌতূহল কেন?
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কৌতূহল খুব একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
মানুষটা মাথা নাড়ল, চলন্ত লরি থেকে পিচিক করে নিচে একটু থুতু ফেলে বলল, ব্যবসা।
রুহান বলল, ব্যবসা?
হ্যাঁ। ব্যবসা।
কিসের ব্যবসা?
মানুষের। তোমাদের ধরে এনেছি বিক্রি করার জন্যে।
বিক্রি করার জন্যে?
হ্যাঁ।
রুহান নিঃশ্বাস আটকে রেখে বলল, কার কাছে বিক্রি করবে?
যে ভালো দাম দেবে তার কাছে।
রুহান এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, যারা ভালো দাম দেবে তাদের কাছে বিক্রি করে দেবে?
হ্যাঁ। অনেক বড় বড় পার্টি আছে। এখন সবচেয়ে বড় যে পার্টি তার নাম ক্রিভান।
ক্রিভান?
হ্যাঁ। সে এখন সবচেয়ে ক্ষমতাশালী। রাতকে দিন করতে পারে দিনকে রাত।
তারা আমাদের নিয়ে কী করবে?
যুদ্ধ করার জন্যে অনেক মানুষের দরকার। ভালো যোদ্ধা পাওয়া খুব সোজা কথা না।
পা ঝুলিয়ে বসে থাকা অন্য একজন বলল, সবাইকে তো আর যুদ্ধ করার। জন্যে কেনে না, অন্য কাজেও কেনে।
অন্য কী কাজে কেনে?
যদি কারো ভালো বুদ্ধি-শুদ্ধি থাকে তাহলে তার মগজটা ব্যবহার করা হয়। মাথার মাঝে ফুটো করে ইলেকট্রড ঢুকিয়ে দেয়। বাইরে থেকে ইমপালস পাঠিয়ে হিসেব নিকেশ করে। তাদেরকে বলে সক্রেটিস।
রুহান নিজের অজান্তে কেমন যেন শিউরে উঠল, সশস্ত্র মানুষটি সেটা লক্ষ্য করল না। খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ক্লোন করার মেশিন তো আজকাল আর পাওয়া যায় না। তাই অনেক সময় হৃৎপিণ্ড, কিডনি, ফুসফুস এইগুলোর জন্যেও বিক্রি হয়। ভালো একজোড়া কিডনির অনেক দাম।
প্রথম মানুষটি বলল, সবচেয়ে বেশি দামে কী বিক্রি হয় জান?
কী?
খেলোয়াড়।
রুহান অবাক হয়ে বলল, খেলোয়াড়?
হ্যাঁ। একটা খেলোয়াড় মগজে ইলেকট্রড লাগানো সক্রেটিস থেকেও একশ দুইশ গুন বেশি দামে বিক্রি হয়।
কীসের খেলোয়াড়?
মানুষটি হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা শেষ করে দেবার ভঙ্গি করে বলল, সবকিছু আগেই জেনে ফেললে হবে কেমন করে? সময় হলে জানবে।
দ্বিতীয়জন বলল, এখন তোমরা ঘুমাও। অনেক দূর যেতে হবে।
প্রথমজন বলল, এত দামি কারগো নিচ্ছি রাস্তাঘাটে অনেক হামলা হবে। গোলাগুলি শুরু হলেই তোমরা মেঝেতে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকবে। বুঝেছ?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি।
রুহান তার নিজের জায়গায় ফিরে আসে। পা ছড়িয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মা আর দুই বোন নুবা আর ত্রিনা এখন কী করছে কে জানে। সে কী আর কোনোদিন তাদের কাছে ফিরে যেতে পারবে?