তুমি শুরু করেছ?
হ্যাঁ।
কী শুরু করেছ?
এই গ্রামে আমার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি, আমি তাই সবাইকে বলেছি আমার ইচ্ছাটাই নিয়ম। আমি যা খুশি তা করতে পারি।
সত্যি?
হ্যাঁ। তুমি ওদের জিজ্ঞেস করে দেখ–সবাই এখন আমাকে ভয় পায়।
মধ্যবয়স্ক মানুষটার মুখে বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠল। মাথা নেড়ে বলল, তুমি সামনে এসো।
গ্রাউস তখন সামনে এগিয়ে গেল। মধ্যবয়স্ক মানুষটা মশালের আলোতে গ্রাউসকে ভালো করে দেখে তারপর অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা আসলেই একে ভয় পাও?
কয়েকজন বিড়বিড় করে অস্পষ্ট গলায় কিছু একটা বলল, তার উত্তর হ্যাঁ কিংবা না দুটোই হতে পারে।
গ্রাউস গলায় একটু উত্তেজনা এনে বলল, আমার সোলার প্যানেলটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমি একজনের বাসা থেকে সেটা খুলে এনেছি। কেউ কিছু বলতে সাহস পায়নি। সেদিন কমবয়েসী একটা মেয়েকেও তুলে আনতে গিয়েছিলাম-
চমৎকার! মধ্যবয়স্ক মানুষটার মুখে হাসি আরও বিস্তৃত হয়, পৃথিবীর নতুন নিয়মটা তুমি তোমার গ্রামে চালু করে দিয়েছ, জোর যার ক্ষমতা তার?
গ্রাউসের মুখে বাঁকা একটা হাসি ফুটে ওঠে, সে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
মধ্যবয়স্ক মানুষটা কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে গ্রাউসের দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর হঠাৎ করে হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা তুলে গ্রাউসের মাথায় ধরে বলল, দেখি তোমার কতটুকু ক্ষমতা।
মুহূর্তে গাউসের মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে বিস্ফারিত চোখে মধ্যবয়স্ক নিষ্ঠুর মানুষটার মুখের দিকে তাকাল। খুব বড় একটা রসিকতা হচ্ছে এরকম একটা ভান করে নিষ্ঠুর চেহারার মধ্যবয়সী মানুষটা ট্রিগার টেনে ধরে। কর্কশ কান ফাটানো একটা শব্দ হলো, রুহান শিউরে উঠে দেখল গ্রাউসের দেহটা একটু লাফিয়ে উঠে নিচে পড়ে যায়। রুহানের মনে হলো সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে, অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
মধ্যবয়স্ক মানুষটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা আবার আলগোছে ধরে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আর কেউ আছে নাকি?
কেউ কোনো কথা বলল না। মধ্যবয়স্ক মানুষটা বলল, কী শিখলে তোমরা। এই ঘটনা থেকে?
এবারেও কেউ কোনো কথা বলল না। মানুষটা সহৃদয় ভঙ্গিতে হেসে বলল, আসলে তোমরা নতুন কিছু শেখ নাই। আমি যেটা বলেছি সেটা শুধু তোমাদের হাতে কলমে দেখালাম, এর বেশি কিছু নয়। আমার হাতে অস্ত্র তাই আমার কাছে ক্ষমতা। আমি যাকে ইচ্ছা খুন করতে পারি। পৃথিবীর কেউ কিছু করতে পারবে না। মধ্যবয়স্ক মানুষটা পা দিয়ে গ্রাউসকে দেখিয়ে বলল, এই আহাম্মকটা দাবি করছিল তার অনেক ক্ষমতা! আসলে তার কোনো ক্ষমতাই ছিল না। খালি হাতে ক্ষমতা হয় না! ক্ষমতার জন্যে দরকার অস্ত্র। বুঝেছ?
দুই-একজন দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল। মানুষটা হাতের মশালটা একটু উপরে তুলে বলল, তোমাদের সবার হাতে আমি অস্ত্র দেব। আমি দেখব তোমাদের কয়জন সেই অস্ত্রের মর্যাদা রাখতে পারে।
রুহান নিঃশব্দে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। তার এখনো বিশ্বাস হতে চায় না যে তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে সত্যিই একজন মানুষ! তার যে কথাগুলো সে শুনছে, সত্যিই একজন মানুষ সেগুলো বলছে।
মানুষটি এবার আস্তে আস্তে হেঁটে তাদের দিকে এগিয়ে এলো। কাছাকাছি। এসে নিচু গলায় বলল, তোমরা সবাই এখন এই লরিগুলোর পিছনে গিয়ে ওঠ। আমি ঠিক পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি।
সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একজন ভাঙ্গা গলায় বলল, আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে?
মানুষটি শীতল গলায় বলল, আমি কী তোমাদের বলেছি যে তোমরা আমাকে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে? বলেছি?
কেউ কোনো কথা বলল না। মানুষটি এবারে হুংকার দিয়ে বলল, সবাই গরিতে ওঠ। যে পিছনে পড়ে থাকবে সে পিছনেই পড়ে থাকবে। অকর্মা বেজন্মা আহম্মকদের এই পৃথিবীতে কোনো জায়গা নেই।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সশস্ত্র মানুষগুলো হঠাৎ করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো তুলে ২৩স্তত গুলি করতে থাকে। প্রচণ্ড গুলির শব্দে তাদের কানে তালা লেগে যায়। তার মাঝে ভয়ে আতঙ্কে অধীর হয়ে সবাই ছোটাছুটি করে লরিতে উঠতে থাকে। পায় সাথে সাথেই লরিগুলোর ইঞ্জিন গর্জন করে পাথুরে পথের উপর দিয়ে ছুটে (ঠতে শুরু করে। হৃদের পাশ দিয়ে যাবার সময় রুহান তাদের ছোট বাসাটা দেখতে পেল। বাসার দরজায় মূর্তির মতো তার মা ছোট বোন দুটিকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়া হলো না, রুহান জানে না আর কোনোদিন তাদের সাথে দেখা হবে কি না।
লরির পিছনে পা ঝুলিয়ে চারজন সশস্ত্র মানুষ বসে আছে। একটু আগেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলি করে তারা একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করছিল। লরি চলতে শুরু করার সাথে সাথে তারা বেশ সহজ ব্যবহার করতে শুরু করল। একজন বেসুরো গলায় গান গাওয়ার চেষ্টা করে, অন্যেরা সেটা নিয়ে হাসি তামাশা করে।
রুহানের পাশে তাদের গ্রামের সবচেয়ে নিরীহ ছেলে কিলি বসেছিল, অন্ধকারে দেখা যায় না কিন্তু রুহান মোটামুটি নিশ্চিত, সে বসে বসে কাঁদছে। এক সময় ভাঙ্গা গলায় জিজ্ঞেস করল, আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে রুহান।
রুহান বলল, আমি জানি না।
তোমার কী মনে হয় রুহান, আমাদের কি মেরে ফেলবে?
কেন? শুধু শুধু মেরে ফেলবে কেন?
গ্রাউসকে যে মেরে ফেলল।
গ্রাউসকে মেরেছে কারণ সে ছিল আহাম্মক। তুমি আর আমি কী আহাম্মক?
কিলি মাথা নেড়ে বলল, না। আমরা আহাম্মক না। কিন্তু—