মা মানুষটার হাত ধরে বলল, দোহাই লাগে তোমাদের। আমার ছেলেকে তোমরা ছেড়ে দাও। তোমাদের পায়ে পড়ি–
মানুষটি ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার মাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। ধাক্কা সামলাতে গিয়ে মা পড়ে যেতে যেতে কোনোভাবে দেওয়াল ধরে। নিজেকে সামলে নেয়। নুবা আর ত্রিনা ভয় পেয়ে ছুটে এসে তাদের মাকে দুই পাশ থেকে জাপটে ধরে ভয় পেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
রুহান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই তাকে ধাক্কা মেরে বাসার বাইরে নিয়ে এলো। রাস্তায় বড় বড় কয়েকটা লরি হেডলাইট জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লরির ইঞ্জিনগুলো ঘরঘর শব্দ করছে। গ্রামের চারপাশে ভয়ঙ্কর ধরনের কিছু মানুষ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হেডলাইটের তীব্র আলোতে এই মানুষগুলোকে কেমন যেন অস্বাভাবিক হিংস্র দেখায়। রুহান দেখতে পেল গ্রামে তার বয়সী যত যুবক সবাইকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে, ভীত মুখে তারা দাঁড়িয়ে আছে। বেশিরভাগই ঘুমের পোশাকে, চুল উষ্কখুষ্ক, চোখে মুখে হতচকিত বিভ্রান্তির ছাপ স্পষ্ট। রুহান গ্রউসকেও দেখতে পেল, তাকেও একজন ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে আসছে।
মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ আলগোছে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ধরে রেখে তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়। তার মাথায় একটা রঙিন রুমাল বাঁধা, পরনে জলপাই রঙের সামরিক পোশাক। বুকের উপর গুলির বেল্ট এবং কোমর থেকে। যোগাযোগ মডিউল ঝুলছে। তার হাতে একটা জ্বলন্ত মশাল, সেটি হাতে নিয়ে
সে চিৎকার করে বলল, সবাই এক লাইনে দাঁড়াও।
ঠিক কীভাবে সবাই হঠাৎ করে এক লাইনে দাঁড়াবে, লাইনটি কী সামনে পিছনে হবে না পাশাপাশি হবে সেটা নিয়ে সবার ভেতরে এক ধরনের হুঁটোপুটি শুরু হয়ে যায়। মধ্যবয়স্ক মানুষটা এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজনের মুখে আঘাত মেরে চিৎকার করে বলল, ইঁদুরের বাচ্চার মতো ছুটাছুটি করছ কেন? পাশাপাশি দাঁড়াও সব নর্দমার পোকা।
রুহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে, সে অপমান কিংবা ক্রোধ অনুভব করে না, তার ভেতরে ভয় বা আতঙ্কও নেই। সত্যি কথা বলতে কী হঠাৎ করে তার বিস্মিত হবার ক্ষমতাটুকুও চলে গেছে। সে একটা অবিশ্বাস্য ঘোরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে, তার চারপাশে কী ঘটছে সে যেন ঠিক বুঝতেও পারে না। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল এবং দেখল তার দুপাশে সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
নিষ্ঠুর চেহারার মধ্যবয়স্ক মানুষটি মশালের আলোতে খুব কাছে থেকে তাদের একজন একজন করে পরীক্ষা করল। যাদেরকে দুর্বল বা রুগ্ন মনে হলো। তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল, যাও, নোংরা আবর্জনা, ছারপোকার বাচ্চারা–ভাগ এখান থেকে।
রুহানের সামনে মানুষটা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ রক্তাভ এবং শরীর থেকে এক ধরনের কটু গন্ধ বের হয়ে আসছে। রুহানের মনে হলো মানুষটা একটা কিছু বলবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু না বলে হেঁটে সামনে এগিয়ে গেল।
সবাইকে এক নজর দেখে মানুষটা আবার সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, হতভাগা জানোয়ারের বাচ্চারা, তোমাদের লজ্জা হওয়া উচিত, বিষ্ঠার সাগরে তোমাদের ড়ুবে মরা উচিত। ছারপোকার বাচ্চাদের মতো তোমাদের টিপে টিপে মারা উচিত। একেকজন এরকম দামড়া জোয়ান হয়ে তোমরা ঘরে বসে আছ, তোমাদের লজ্জা করে না?
মানুষটি সবার দিকে তাকাল, কেউ কোনো উত্তর দিল না।
কথা বলছ না কেন, আহাম্মকের বাচ্চারা?
এবারেও কেউ কোনো কথা বলল না। মধ্যবয়স্ক মানুষটা মাটিতে থুতু ফেলে বলল, এই জঙ্গলের মাঝে থাক, দুনিয়ার কোনো খোঁজ খবর রাখ না। তোমরা কী জান সারা পৃথিবীতে এখন কী হচ্ছে? মানুষটা সবার দিকে একবার মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল, জান না! আমি জানতাম তোমরা জানবে না। সারা দুনিয়ায় এখন যুদ্ধ হচ্ছে। সবার সাথে সবার যুদ্ধ। যার গায়ে জোর আছে, যার শক্তি আছে সে টিকে থাকবে। যার জোর নাই, শক্তি নাই সে ধ্বংস হয়ে যাবে। এখন তোমরা বল, তোমরা কী টিকে থাকতে চাও নাকি ধ্বংস হতে চাও?
কেউ কোনো কথা বলল না। মানুষটা তখন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা বাঁকিয়ে বলল, কেউ কথা বল না কেন?
ভয় পেয়ে কয়েকজন বিড় বিড় করে বলল, টিকে থাকতে চাই।
চমৎকার! মানুষটা তার নোংরা দাঁত বের করে হাসার চেষ্টা করে বলল, আমরা তোমাদের টিকে থাকার একটা সুযোগ করে দেব। এই নতুন পৃথিবীতে নতুন নিয়ম। যার জোর আছে, ক্ষমতা আছে সে যেটা বলবে সেটাই হবে। নিয়ম। যার জোর নাই সে মাথা নিচু করে সেই নিয়ম মানবে। বুঝেছ?
রুহান একটু অবাক হয়ে মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকাল। গ্রাউস যে কথাগুলো বলেছিল এই মানুষটি ঠিক সেই কথাটাই বলছে। তাহলে কী নতুন পৃথিবীতে এইটাই নিয়ম? যার ক্ষমতা আছে সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে? পৃথিবীতে ন্যায় অন্যায় বলে কিছু থাকবে না? সত্যি-মিথ্যা বলে কিছু থাকবে না? যার ক্ষমতা আছে সে যত বড় দানবই হোক, তার ইচ্ছেটাই হবে সব?
ঠিক তখন কে যেন কিছু একটা বলল, মধ্যবয়স্ক মানুষটা সেদিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে মাথা উঁচু করে বলল, কে কথা বলে?
রুহান এবারে শুনল গ্রাউস বলছে, আমি। আমি কথা বলছি।
তুমি কী বলতে চাও ছেলে?
গ্রাউস উত্তেজিত গলায় বলল, তুমি যেটা বলছ আমিও সেটা বলি। আমাদের গ্রামে আমি সেটা শুরু করেছি।