রুহানদের এলাকাটা এতদিন বেশ ভালোই ছিল, বেঁচে থাকার জন্য কিছু নিয়ম তৈরি করে সবাই দিন কাটাচ্ছে, কিন্তু সেটা আর থাকবে বলে মনে হয় না। একটু আগে সে নিজেই কিসিমার বাসায় গ্রাউসের কাজকর্ম দেখে এসেছে। তবুও সে কিছু না জানার ভান করে জিজ্ঞেস করল, নতুন কিছু হয়েছে নাকি?
মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললে বলল, হয়নি আবার। প্রত্যেকদিনই কিছু একটা হচ্ছে। এই তো সেদিন কয়জন এসে তিয়াশার বাসার একটা সোলার প্যানেল খুলে নিয়ে গেছে।
রুহান এটার কথাও জানে, তারপরেও না জানার ভান করে বলল, তাই নাকি?
হ্যাঁ। মা গলা নামিয়ে বলল, কিসিমার মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যাবে বলে গ্রাউস কয়দিন থেকে হুমকি দিচ্ছে শুনেছিস?
রুহান একটু আগেই সেটা নিজের চোখে দেখে এসেছে, শেষ মুহূর্তে গ্রাউস পিছিয়ে না গেলে কিছু একটা হয়ে যেতে পারত কিন্তু মাকে সেটা বলার ইচ্ছে। করল না।
মা আড় চোখে তারা ছোট দুটি মেয়ে নুবা আর ত্রিনার দিকে তাকাল। তারপর ফিস ফিস করে বলল, এই দুজন যখন বড় হবে তখন যে কী হবে!
রুহান তার ছোট দুই বোনের দিকে তাকাল। সে তার মায়ের সাথে কী নিয়ে কথা বলছে সেটা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। এই মুহূর্তে ক্রিস্টাল রিডারে নতুন একটা ক্রিস্টাল ঢুকিয়ে বিচিত্র একটা সঙ্গীতের মর্মোদ্ধার করার চেষ্টা করছে। এই বয়সের ছেলে-মেয়ের নিজেদের একটা জগত আছে, তার বাইরে যারা থাকে তারা সেই জগতটার কিছুই বুঝতে পারে না।
মা নুবা আর ত্রিনার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হলো? তোরা খাবার টেবিলে বসে কী শুরু করেছিস? খাচ্ছিস না কেন?
নুবা ঠোঁট উল্টে বলল, তোমার এই শুকনো রুটি আর জ্যালজেলে স্যুপ দুই মিনিট পরে খেলে কিছু ক্ষতি হবে না।
মা একটু আহত গলায় বলল, এটাই যে পাচ্ছিস তার জন্যেই খুশি থাক। সামনে কী দিন আসছে কে জানে?
ক্রিস্টাল রিডার থেকে একটা বিদঘুটে শব্দ বের হয়ে এলো। সাথে সাথে দুই বোন হেসে কুটি কুটি হয়ে যায়। মা ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল, কী হচ্ছে? এই বিদঘুটে শব্দের মাঝে তোরা হাসির কী পেলি?
ত্রিনা মুখ গম্ভীর করে বলল, তুমি বিদঘুটে কী বলছ মা? এটা নতুন ধরনের সঙ্গীত। এটা যে তৈরি করেছে তার চেহারা দেখলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। সবুজ রঙের চুল, গোলাপি-
ব্যস! অনেক হয়েছে। মা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, যে মানুষের চুল সবুজ, তাকে নিয়ে আমি কোনো কথা শুনতে চাই না।
নুবা বলল, কী বলছ মা? ক্রোমোজমের একটা জিনকে পাল্টে দিলেই চুল সবুজ হয়ে যায়। আমার যদি একটা ছোট জিনেটিক ল্যাব থাকত-
থাক। এমনিতেই পারি না, এখন আবার জিনেটিক ল্যাব।
নুবা তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, রুহান, একটা জিনেটিক ল্যাব তৈরি করতে কত ইউনিট লাগবে?
রুহান লাল রঙের পানীয়টা এক ঢোক খেয়ে বলল, সেটা তো জানি না! এখন তো আর ইউনিটেরও কোনো মূল্য নেই। পৃথিবীতে যখন নেটওয়ার্ক ছিল তখন সবকিছু করা যেত। এখন তো কিছু করারও উপায় নেই।
ত্রিনা মাথা নেড়ে বলল, পৃথিবীটা কেন এরকম হয়ে গেলা রুহান?
রুহান একটু মাথা নেড়ে বলল, সেটাই যদি জানতাম তাহলে তো কাজই হতো!
ত্রিনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে, বার বছরের ছোট কচি একটা মুখের সাথে সম্পূর্ণ বেমানান একটা বিষণ্ণতা সেখানে এসে ভর করে। বলে, সবাই মিলে
পৃথিবীকে কেন আগের মতো করে ফেলে না?
এই প্রশ্নটির উত্তর রুহানের জানা নেই। সে নিঃশব্দে খাবার টেবিলে বসে রইল।
০২. ঘুম থেকে উঠে
ঘুম থেকে উঠে কী হচ্ছে বুঝতে রুহানের একটু সময় লাগল। লাথি দিয়ে দরজা খুলে তার ঘরে কয়েকজন ঢুকে গেছে। কিছু বোঝার আগেই একজন রুহানকে টেনে বিছানা থেকে তুলে নেয়, তারপর ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। আবছা আলোয় মানুষগুলোর চেহারা স্পষ্ট দেখা যায় না, শুধু নিষ্ঠুরতার ছাপটুকু বোঝা যায়। তারা আলগোছে লেজার গাইডেড স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো ধরে রেখেছে, বুকের উপর গুলির বেল্ট, মাথায় রঙিন রুমাল বাঁধা। পিঠে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঠেকিয়ে যে মানুষটি রুহানকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল তাকে সে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কারা? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
মানুষটি রুহানকে ধাক্কা দিয়ে একটা অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করে বলল, এত খবরে তোমার দরকার কী?
রুহান হলঘরে এসে দেখল তার মা নুবা আর ত্রিনাকে দুইহাতে শক্ত করে ধরে রেখে ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের চোখে মুখে অবর্ণনীয় আতঙ্ক, নুবা ত্রিনার মুখে বিস্ময়। রুহানকে ঠেলে নিয়ে আসতে দেখে মা কাতর গলায় জিজ্ঞেস করল, আমার ছেলে কী করেছে? তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
মানুষগুলো তার কথার কোনো উত্তর দিল না। তখন মা ছুটে এসে একজনের হাত ধরে বলল, কী হলো? তোমরা কথা বলছ না কেন? কী করেছে আমার ছেলে?
মানুষটি ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, তোমার ছেলে কিছু করে নাই।
তাহলে তাকে কেন ধরে নিয়ে যাচ্ছ? এই সময়ে কিছু না করাটাই অপরাধ।
কম বয়সী হালকা পাতলা একটা মানুষ হা হা করে হেসে উঠল, যেন খুব মজার একটা কথা শুনতে পেয়েছে। হাসতে হাসতেই বলল, ঠিকই বলেছ। সারা দুনিয়াতে মারামারি হচ্ছে আর জোয়ান একটা ছেলে কিছু না করে ঘরে বসে থাকবে মানে?
মা পিছু পিছু এসে বলল, কিন্তু আমার ছেলে তো কখনো মারামারি করে নি। কখনো কোনো অন্যায় করেনি–
হালকা পাতলা মানুষটা বলল, আমরাই কী আগে করেছি নাকি? শিখে নিয়েছি। তোমার ছেলেও শিখে নেবে। যুদ্ধ করার জন্যে যৌবন কাল হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সময়।