ক্ৰানা মাথা নেড়ে বলল, না, ক্ৰিভন! তুমি বুঝতে পারছ না। কেউ যখন ভালোবাসার কথা বলে তখন তাকে হত্যা করা যায় না।
ক্রিভন চমকে উঠে বলল, তুমি কী বললে?
আমি বলেছি, মানুষ যখন মানুষের কাছে ভালোবাসার কথা বলে তখন তাকে হত্যা করা যায় না!
কিন্তু কিন্তু–
ক্ৰানা হেসে বলল, মনে নেই তুমি কাটুশকার শেলে স্কু খুলে পানি ঢুকিয়েছ?
হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে?
পুরো রাসায়নিক উপাদানগুলো তখন নষ্ট হয়ে গেছে। আমি তোমাকে মিথ্যে কথা বলেছি ক্রিভন।
ক্ৰিভন চিৎকার করে বলল, তুমি আমার সাথে মিথ্যা কথা বলতে পার না। এটা অসম্ভব। তুমি মানুষ নও তুমি মস্তিষ্কের একটা বিচ্যুতি–
তুমি ঠিকই বলেছ। আমার মিথ্যা বলার কথা নয়, শুধু একটি ব্যতিক্রম আছে। যদি কোথাও আমি একটি ক্রস দেখতে পাই, আমার সমস্ত যুক্তি তর্ক ওলটপালট হয়ে যায়! আমার ভেতরে ভালোবাসার বান ডেকে যায়-–
না! ক্ৰিভন চিৎকার করে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে যায়, অবাক হয়ে একবার ক্রানার দিকে আরেকবার রিদি আর রুহানের দিকে তাকায়। ক্রানা হাসি মুখে বলল, তুমি ছোটাছুটি করো না, তোমার জিভের নিচে যে ক্যাপসুলটা দিয়েছ সেটা কোনো প্রতিষেধক নয়, সেটা ঘুমের ওষুধ! তুমি ঘুমিয়ে পড়ছ ক্ৰিভন। শুধু তুমি নও, তোমরা সবাই।
না। ক্ৰিভন গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বলল, এটা হতে পারে না।
পারে। আমি যদি একটা মিথ্যা বলতে পারি তাহলে দশটা মিথ্যা বলতে পারি। আমি অবশ্যি দশটা মিথ্যা বলি নি। মাত্র তিনটা মিথ্যা বলেছি! তিন নম্বর মিথ্যাটা কী জান?
ক্রিভন কোনো কথা না বলে স্থির চোখে কানার দিকে তাকাল। ক্রানা খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, তোমাদের অস্ত্রগুলোর ভেতরে একটা কোড ঢুকিয়েছ মনে আছে? কোডগুলো অস্ত্রটাকে অকেজো করে দেয়। তোমার পুরো সেনাবাহিনীর কারো কাছে এখন কোনো অস্ত্র নেই! একটিও নেই!
ক্রিভন হাঁটু গেড়ে কয়েক পা এগিয়ে এসে কোমর থেকে হঠাৎ একটা ছোট রিভলবার বের করে হিংস্র গলায় বলল, আছে! একটা অস্ত্র এখনো আছে। এই অস্ত্রের কোনো কোড নেই। সেটা দিয়েই আমি তোমাদের শেষ করব।
ক্ৰিভন অস্ত্রটা প্রথমে রুহানের দিকে তাক করল। ট্রিগার টানার সাথে সাথে প্রচণ্ড একটা শব্দে কানে তালা লাগা গেল, শেষ মুহূর্তে রিদি তারই চেয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, নিজের শরীর দিয়ে রক্ষা করেছে রুহানকে।
রুহান বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে। ক্রিভনের দেহের উপর রিদি উপুড় হয়ে পড়ে আছে। জোছনার নরম আলোতে দৃশ্যটিকে মনে হয় অতিপ্রাকৃতিক। যে ক্ষীণ কালচে তরলটি গড়িয়ে আসছে, সেটি রক্তের ধারা। জোছনার আলোতে সেটিকে লাল দেখাচ্ছে না, সেটাকে দেখাচ্ছে কালো!
রুহান তবুও জানে এটা রক্ত। রিদির রক্ত।
১৪. রুহানের পাশে পাশে হাঁটছে ক্রিটিনা
রুহানের পাশে পাশে হাঁটছে ক্রিটিনা। নদীর তীরে একটা বড় গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রুহান বলল, তুমি এখন যাও।
ক্রিটিনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোমাকে একা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না রুহান।।
রুহান শব্দ করে হেসে বলল, পৃথিবীটা এর মধ্যে অন্যরকম হয়ে গেছে ক্রিটিনা। মানুষের এখন অন্য মানুষকে দেখে ভয় পেতে হয় না। তারা একা বের হতে পারে, তাদের অস্ত্র নিয়ে বের হতে হয় না।
সব তোমার জন্যে।
না। আমার জন্যে নয়–আমাদের জন্যে। রুহান গলার স্বর পাল্টে বলল, তোমার কী মনে হয় ক্রিটিনা রিদি ভালো হয়ে উঠবে না?
উঠবে। একটু সময় লাগবে, কিন্তু ভালো হয়ে যাবে।
আর ক্রানা?
ক্রানা খুব হাসিখুশি আছে। একেবারে শিশুর মতোন। কিহি চলে আসার পর কী খুশি হয়েছে তুমি দেখেছ?
দেখেছি। ক্রানার মতো সবাই কিহিকে খুব ভালোবাসে। রুহান বলল, তুমি জান কিহি আমাকে পড়তে শিখিয়েছিল।
ক্রিটিনা বলল, আর তুমি শিখিয়েছ আমাকে।
আমি যদি না শেখাতাম তাহলে কী সর্বনাশ হতো চিন্তা করেছ?
ক্রিটিনা হেসে বলল, খুব ভালো করে শেখাও নি। দেয়ালে তোমার লেখাটা পড়তে আমার অনেকক্ষণ লেগেছিল।
তাতে কিছু আসে যায় না। সেটা পড়েছ, পড়ে যেটা করার কথা সেটা করেছ সেটাই বড় কথা! এখন সবাইকে পড়তে শিখিয়ে দাও, কিহি তোমাকে সাহায্য করতে পারবে। ক্রিস্টাল রিডারের উপর আর ভরসা করে থাকার দরকার নেই।
রুহান হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, ক্রিটিনা, তুমি এখন যাও।
ক্রিটিনা মাথা নেড়ে বলল, তোমাকে ছাড়তে মন চাইছে না রুহান।
রুহান ক্রিটিনার মুখের দিকে তাকাল, তার চোখের কোণায় পানি চিক চিক করছে। রুহান ক্রিটিনার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, আমারও তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না ক্রিটিনা। কিন্তু আমাকে যেতে হবে। কতদিন আমার মাকে দেখিনি। আমার ছোট দুটি বোন আছে, নুবা আর ত্রিনা তাদেরকেও দেখিনি। তারা কোথায় আছে, কেমন আছে আমি জানি না–
তুমি তাহলে কথা দাও আবার তুমি ফিরে আসবে।
আমি আবার আসব ক্রিটিনা।
আমার কাছে আসবে?
তোমার কাছে আসব।
আমি প্রতিদিন বিকেলে এখানে এসে এই পথের দিকে তাকিয়ে থাকব।
রুহান হেসে বলল, পাগলী মেয়ে! প্রতিদিন কেন অপেক্ষা করবে।
আমি করব। বলে ক্রিটিনা ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল।
রুহান যখন তার বাসায় পৌঁচেছে তখন গভীর রাত। দরজায় শব্দ শুনে মা জিজ্ঞেস করলেন, কে এসেছে?
আমি মা। আমি রুহান।
মা দরজা খুলে অবাক হয়ে রুহানের দিকে তাকালেন। ফিসফিস কতে বললেন, তুই এসেছিস?
হ্যাঁ মা। আমি এসেছি। মা বললেন, আয় বাবা একটু কাছে আয়।