রুহান আর রিদি বিস্ফোরিত চোখে কানার শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার শরীরে বড় বড় দুটি টিউব বাঁধা। টিউবগুলো দুজনেই চেনে। এগুলো হাইব্রিড বিস্ফোরক। দুটো প্রয়োজন নেই একটা টিউব বিস্ফোরিত হলেই এই পুরো গ্রাম ভস্মীভূত হয়ে যাবে, কিন্তু ক্ৰিভন দুটি হাইব্রিড বিস্ফোরক শো দিয়েছে কারণ গ্রামটাকে ভস্মীভূত করা তার উদ্দেশ্য নয়। তার উদ্দেশ্য ভয় দেখানো।
ক্রানা ডান হাতে শক্ত করে লিভারটা চেপে ধরে রেখে বিড়বিড় করে বলাকা, ক্ৰিভন খুব মজার মানুষ। এক কথা অনেকবার বলে। অনেকবা। অনেকবার। আমাকে বলেছে রিদি আর রুহানকে খুঁজে বের করে নিয়ে যেতে। অনেকবার বলেছে। আর কী বলেছে জান? বলেছে রিদি আর রুহান যদি এক। কথা উচ্চারণ করে তাহলে এই লিভারটা ছেড়ে দিতে! কী আশ্চর্য একটা কথা!
রুহানের মনে হলো তার মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত ব যেতে শুরু করেছে। মনে হলো সে বুঝি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে যাবে। ক্ৰানা এদিক সেদিক তাকিয়ে আবার আপন মনে বলে, রিপি রুহান তোমরা কী কথা বলবে? একটা কথা। মাত্র একটা কথা! তাহলে আমি লিভারটা ছেড়ে দিতাম–দেখতাম কী হয়! কী হবে বলে তোমার মনে হয়? তোমরা কী জান? রিদি? রুহান? তোমরা জান? জান কী হয়?
ক্রানার সামনে দাঁড়িয়ে রিদি আর রুহান কুলকুল করে ঘামতে থাকে। হেরে গেছে! তারা জানে তারা হেরে গেছে। ক্ৰিভনের মতো একজন অসুস্থ মানুষ কী। সহজে তাদের হারিয়ে দিল!
১৩. ক্রিটিনাদের গ্রাম
উঁচু জায়গাটা থেকে ক্রিটিনাদের গ্রামটা স্পষ্ট দেখা যায়। দিনেরবেলা হলে আরও স্পষ্ট দেখা যেত। এখন রাত, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ, চাদের আলোতে সবকিছুই একটু অন্যরকম দেখায়। আবছা এবং রহস্যময়। গ্রামে ছোট ছোট বাসা, বাসার সামনে একটু খোলা জায়গা, খোলা জায়গা ঘিরে গাছ-গাছালি বাগান। এখন অনেক রাত বলে বাসাগুলো অন্ধকার থাকার কথা কিন্তু অনেক বাসাতেই আলো জ্বলছে। রিদি, রুহান আর প্রায় তিনশ সশস্ত্র মানুষকে আশ্রয় দেবার জন্যে গ্রামের মানুষেরা কাজকর্ম করছিল। রিদি রুহানকে ধরে নিয়ে আসার পর এখন গ্রামের মানুষদের ভেতর ভয়, আশঙ্কা আর উত্তেজনা। এই জায়গাটা থেকে সেই উত্তেজনাটুকু দেখা যায়। মানুষজন ভীত বিহ্বল হয়ে ছোটাছুটি করছে। কাছে থাকলে হয়তো তাদের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দও শোনা যেত।
রিদি আর রুহানকে দুটি ধাতব চেয়ারে বেঁধে বসানো হয়েছে, তৃতীয় চেয়ারটিতে বসেছে ক্ৰানা। ক্রানাকে বেঁধে না রাখলেও হতো কিন্তু তবু তাকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে যেন হঠাৎ করে উঠে না পড়ে। সে বিড়বিড় করে একটানা নিজের সাথে কথা বলে যাচ্ছে। হঠাৎ করে শুনলে মনে হয় অর্থহীন কিন্তু মন দিয়ে শুনলে একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে যা ঘটছে তার পুরো ব্যাপারটা নিয়ে জানার ভেতরে একটা বিস্ময়, কী ঘটছে কেন ঘটছে। সেটা নিয়ে তার ভেতরে অসহায় এক ধরনের প্রশ্ন।
ক্ৰিভনের জন্যেও একটা চেয়ার রাখা হয়েছে। তার চেয়ারটি নরম এবং আরামদায়ক। চেয়ারটিতে সে বসে নি, সেখানে তার একটা পা তুলে সে ক্রিটিনাদের গ্রামের দিকে তাকিয়ে আছে। জোছনার আলোতে গ্রামটিকে মনে হচ্ছে রহস্যময় এবং অলৌকিক। ক্ৰিভন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, রিদি এবং রুহান, তোমরা দুজন মানুষ আমার অনেক ক্ষতি করেছ। শুধু আমার না, আরো অনেকের।
রিদি কিংবা রুহান কেউ কোনো কথা বলল না। ক্ৰিভন বলল, তোমরা কেন এসব করছ আমি জানি না। আমি চিন্তা করে তার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। অনেক চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত একটা অর্থ খুঁজে পেয়েছি, সেটা কী জান? সেটা হচ্ছে নির্বুদ্ধিতা। চরম নির্বুদ্ধিতা। এই পৃথিবীটা নির্বোধ মানুষের জন্যে না–এই পৃথিবীটা হচ্ছে বুদ্ধিমান মানুষের জন্যে। তোমাদের এই পৃথিবীতে থাকার কোনো অধিকার নেই।
ক্রিভন চেয়ার থেকে পা নামিয়ে দুই পা হেঁটে সামনে গিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু নির্বুদ্ধিতা হোক আর যাই হোক, তোমরা আমার অনেক বড় ক্ষতি করেছ। সেই ক্ষতিটা আমাকে পুষিয়ে নিতে হবে। যেভাবে হোক।
সেটা করার জন্যে আমাকে কী করতে হবে জান? প্রথমে সবার কাছে প্রমাণ করতে হবে যে যারা তোমাদের সাথে থাকে তারা হচ্ছে নির্বোধ! তারা এত নির্বোধ যে তারা পোকা মাকড়ের মতো মারা পড়ে। ঘটনাটা ঘটানোর জন্যে আমি নিজে এই গণ্ডগ্রামে চলে এসেছি। এখানে বসে থেকে সামনের যে গ্রামটা আছে সেটাকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেব। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই গ্রামে একটা মানুষ দূরে থাকুক একটা টিকটিকিও বেঁচে থাকবে না! কী আনন্দ, তাই না?
ক্রিভন কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ গ্রামটার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর মাথা ঘুরিয়ে রিদি আর রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু শুধু গ্রামবাসীদের পোকামাকড় ব্যাক্টেরিয়া ভাইরাসের মতো মারলে তো হবে না তোমাদের দুইজনকেও একটা শাস্তি দিতে হবে। সেটি হতে হবে এমন যন্ত্রণার একটি শাস্তি যেটা তোমাদের শরীরের প্রত্যেকটা কোষ, তোমাদের মস্তিষ্কের প্রত্যেক নিউরন সেল, তার প্রত্যেকটা সিনান্স কানেকশান যেন মনে রাখে। যন্ত্রণাটা শুধু তোমাদের দিলে তো হবে না সেটা সবাইকে দেখাতেও হবে। বিশাল একটা স্টেডিয়ামের মাঝখানে তোমাদের শাস্তিটা দেব, কয়েক লাখ মানুষ স্টেডিয়ামে টিকেট কেটে সেটা দেখতে আসবে–এটা হচ্ছে আমার পরিকল্পনা। এই এলাকার পুরো মানুষ জানবে ক্রিভনের সাথে কেউ যদি লাগতে আসে তা কোনো মুক্তি নেই। ক্ৰিভনের চোখ দুটি জ্বলে ওঠে, সে হিসহিস করে বল, দরকার হলে তাদের আমি নরক থেকে ধরে আনব, ধরে এনে শাস্তি দেব।