ক্রিটিনা চোখ মুছে বলল, হ্যাঁ মা ফিরে এসেছি।
আমি ভেবেছিলাম তোকে আর কোনোদিন দেখব না।
ক্রিটিনা বলল, আমিও তাই ভেবেছিলাম মা, কিন্তু এই যে দুইজন রুহান আর রিদি তারা সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। তারা আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে।
ক্রিটিনার মা অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, জানি। আমি সব জানি। এখন সবাই জানে। এই এলাকার সব মানুষের মুখে মুখে এখন একটা মাত্র কথা।
কী কথা মা?
ঈশ্বর দুজন দেবদূতকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে, তারা এখন সারা পৃথিবীর সব মানুষের দুঃখ কষ্ট দূর করে দেবে।
ক্রিটিনা খিলখিল করে হেসে বলল, না মা, ওরা দেবদূত না। ওরা মানুষ। একটু বোকা সোকা কিন্তু একেবারে একশ ভাগ মানুষ। তারা যে কাজটা করছে সেই কাজটা দেবদূতরা পারত না, শুধু মানুষেরাই এই কাজ পারে।
আমাকে ঐ মানুষগুলোর কাছে নিয়ে যাবি? আমি ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে তাদের মঙ্গলের জন্যে প্রার্থনা করব?
এসো মা আমার সাথে।
ক্রিটিনা তার মাকে নিয়ে রুহান আর রিদিকে খুঁজে বের করে আবিষ্কার করল হারানো সন্তানদের মায়েরা রুহান আর রিদিকে ঘিরে রেখেছে। কেউ কেউ আকুল হয়ে কাঁদছে, কেউ কেউ তাদের হাত ধরে সেখানে চুমু খাবার চেষ্টা করছে।
রুহান কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু অনেক মানুষের ভিড়ে সে কিছু বলতে পারছে না। ক্রিটিনা তখন রুহান আর রিদিকে উদ্ধার করার জন্যে এগিয়ে যায়, সবাইকে ঠেলে সরিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, তোমরা সবাই সরে যাও। এই দুজন মানুষ অনেক দূর থেকে অনেক কষ্ট করে আমাদের সবাইকে উদ্ধার করে এনেছে। মানুষগুলো ক্লান্ত, তাদের একটু বিশ্রাম নিতে দাও।
মায়েরা চিৎকার করে বলল, আমরা আমাদের বাড়িতে তাদের জন্যে বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছি। আমাদের বাড়িতে খাবারের ব্যবস্থা করেছি। আমরা তাদের আমাদের বাড়ি নিয়ে যেতে চাই!
ক্রিটিনা বলল, দুজন মানুষ ত্রিশজনের বাড়িতে যেতে পারবে না! তাদের। সাথে আরো তিনশ মানুষ আছে। তাদের সবার একটা ব্যবস্থা করতে হবেতোমরা আপাতত তাদের মুক্তি দাও।
কমবয়সী একজন মা বলল, আমরা তাদের কোনো একটা কথা শুনতে চাই।
ক্রিটিনা রুহানের হাত স্পর্শ করে বলল, রুহান তুমি কিছু একটা বল।
কী বলব?
ক্রিটিনা কাঁধ বাঁকিয়ে বলল, আমি জানি না। যা ইচ্ছে হয় বল!
রুহান একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে গলা উঁচু করে বলল, আপনাদের কাছে আপনাদের সন্তানদের ফিরিয়ে আনতে পেরে আমাদের খুব ভালো লাগছে।
অনেক মানুষের ভিড়, সবার কথাবার্তায় জায়গাটা সরগরম হয়ে ছিল, রুহান কথা বলতে শুরু করতেই সবাই চুপ করে গেল, চারপাশে হঠাৎ করে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। রুহান সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, কাজটা ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ণ। সত্যি কথা বলতে কী যখন আমরা সেটা শুরু করেছিলাম তখন ঠিক কীভাবে আমরা করব সেটা জানতাম না। তারপর আমরা সেটা শুরু করেছিলাম।
রুহান একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমরা অসম্ভব আনন্দিত, আমরা সেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটা শুরু করেছিলাম। সে কারণে আজ আপনাদের আপনাদের সন্তানদের ফিরে পেয়েছেন। কিন্তু এই কাজটি করার কাতা। আরেকটি খুব বড় কাজ হয়েছে! মানুষ আবার নতুন করে বিশ্বাস করতে। করেছে যে একজনকে শুধু অন্যায় আর অপরাধ করে বেঁচে থাকতে হবে। মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে ঘৃণা করে, তাদের উপর অত্যাচার করে দিন কাটাতে হবে না। মানুষ মানুষকে ভালোবাসতে পারবে, তাদের সম্মান করতে পার। এবং তার পরেও মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারবে।
রুহান এক মুহূর্তের জন্যে থামতেই সবাই এক ধরনের আনন্দধ্বনি কর। তার ঠিক কোন কথাটাতে সবাই এত আনন্দ পেয়েছে রুহান তা ধরতে পারল না। কম বয়সী একটি মা চিৎকার করে বলল, এখন আমরা অন্যজনের মুখে কিছু শুনতে চাই!
রিদি হাত নেড়ে বলল, আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না! রুহান যেটা বলেছে সেটাই আমার কথা।
এবারে অনেকে চিৎকার করে বলল, না, না, আমরা তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
রিদি একটু ইতস্তত করে বলল, রুহানের সব কথা ঠিক। তবে আমি সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, যারা পৃথিবীটাকে একটা নরকে পরিণত করেছে তারা কিন্তু এত সহজে এটা মেনে নেবে না। তারা পাল্টা আঘাত হানা। চেষ্টা করবে, প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবে। আমাদের সে জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা যেটা শুরু করেছি সেটা এখনো শেষ হয়নি–সবাই মিলে সেটা শেষ করতে হবে!
এবারেও অনেকেই আনন্দের একটা শব্দ করল, যদিও রিদি যে কথাগুলো বলেছে সেটা মোটেও আনন্দের কথা নয়, সেটা ছিল খুব ভয়ের কথা, খুব আশঙ্কার কথা।
প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কেটে যাবার পর যখন গভীর রাতে সবাই ঘুমাতে গিয়ে তখন রিদি আর রুহান অনেকক্ষণ পর নিরিবিলি কথা বলার সুযোগ পেল। রিদি চোখ মটকে বলল, কেমন বুঝতে পারছ রুহান!
রুহান জিজ্ঞেস করল, তুমি কীসের কথা বলছ?
সব মিলিয়েই বলছি। তুমি যখন লাল পাহাড়ের বাজারে ক্রিটিনা আর অন্য ছেলে-মেয়েদের বাঁচানোর জন্যে তোমাদের অস্ত্রটা বের করেছিলে তখন কী তুমি কল্পনা করেছিলে এরকম একটা কিছু ঘটবে?
না। ভাবি নি।
তুমি কী ভেবেছিলে?
রুহান বলল, আমি কিছুই ভাবি নি। মানুষ হয়ে মানুষকে বেচা-কেনা করা যায় না, যেভাবেই হোক সেটা থামাতে হবে, এটা ছাড়া আর কিছুই ভাবি নি।
এখন তুমি বুঝতে পারছ কী ঘটছে? কী ঘটছে?