এটার নাম বই। আগে যখন সব মানুষের কাছে ক্রিস্টাল রিডার ছিল না তখন তারা এই রকম বই পড়ত।
কী আশ্চর্য! ক্রিটিনা রুহানের পাশে ঝুঁকে পড়ে বলল, দেখি তোমার বইটি।
ক্রিটিনা রুহানের এত কাছে ঝুঁকে এসেছে সে মেয়েটির মাথার চুলের হালকা এক ধরনের সুবাস পেল। বিবর্তনে মানুষের যে ইন্দ্রিয়গুলোর বিকাশ ফটেছে ঘ্রাণ তার একটি নয়, যদি হতো সে নিশ্চয়ই এই মেয়েটির শরীরের ঘ্রাণ তীব্রভাবে অনুভব করতে পারত।
ক্রিটিনা বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে বলল, কী আশ্চর্য! এখানে দেখছি নানা ধরনের চিহ্ন!
হ্যাঁ। এগুলোকে বলে বর্ণমালা। বর্ণমালা সাজিয়ে সবকিছু লেখা হয়।
সত্যি?
হ্যাঁ।
তুমি বর্ণমালা পড়তে পার?
হ্যাঁ। আমি শিখেছি।
ক্রিটিনা অবাক হয়ে বলল, তুমি আমাকে পড়ে শোনাও দেখি এখানে কী লেখা আছে।
রুহান পড়ল, মানুষের চোখ অত্যন্ত সংবেদনশীল। মাত্র সাতটি ফোটন হলেই চোখের রেটিনা সেটাকে দেখতে পায়। বিবর্তনের কারণে যদি চোখ আর মাত্র দশ গুণ বেশি সংবেদনশীল হয়ে যেত তাহলে খালি চোখেই আমরা কোয়ান্টাম প্রক্রিয়া দেখতে পেতাম–
ক্রিটিনা চোখ বড় বড় করে বলল, বাবা গো! কী কটমটে কথা!
রুহান হেসে বলল, এটা মোটেও কটমটে কথা না। এটা খুব সাধারণ কথা। আসলে আমরা তো ক্রিস্টাল রিডারে অভ্যস্ত হয়ে গেছি তাই বই থেকে পড়লে কিছু বুঝতে পারি না।
ক্রিটিনা ভুরু কুঁচকে বলল, এখন তো পৃথিবীতে আর ক্রিস্টাল রিডার তৈরি হয় না, তাই না?
না।
তার মানে আমাদের আবার এরকম বই পড়া শিখতে হবে?
রুহান সোজা হয়ে বসে বলল, হ্যাঁ। আসলে আমি ঠিক এই কথাটা সবাইকে বোঝাতে চাই কিন্তু কেউ সেটা বুঝতে চায় না। যতদিন পৃথিবীটা আবার ঠিক না হয় সবার কাছে ক্রিস্টাল রিডার না থাকে ততদিন কী ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করবে না? একশবার করবে!
এই রকম বই দিয়ে?
হ্যাঁ। রুহান ক্রিটিনার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি জানি তুমি আমার কথা বিশ্বাস করতে চাইছ না। কিন্তু বিশ্বাস কর–
ক্রিটিনা হেসে বলল, কে বলেছে আমি তোমার কথা বিশ্বাস করছি না? আমি অবশ্যই তোমার কথা বিশ্বাস করেছি।
রুহান মাথা নেড়ে বলল, না, তুমি আসলে আমার কথা বিশ্বাস কর নি। তুমি আমাকে খুশি করার জন্যে এই কথাটা বলছ।
ঠিক আছে। ক্রিটিনা মুখ টিপে হাসল। হেসে বলল, এখন তা হলে তোমাকে আরেকটা কথা বলি, এই কথাটা শুনলে তুমি বুঝবে যে আসলেই আমি তোমার কথা বিশ্বাস করেছি।
কী কথা বলবে?
তুমি কী আমাকে পড়তে শেখাবে?
রুহানের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, তুমি সত্যি আমার কাছে শিখতে চাও?
হ্যাঁ। শিখতে চাই।
কেন?
ক্রিটিনা শব্দ করে হাসল। হেসে বলল, না! তোমাকে খুশি করার ও! আমি ঠিক করেছি আমাদের গ্রামের স্কুলটা আমি আবার চালু করব। স্কুলে। বাচ্চাদের আমি পড়তে শেখাব। তারা যেন কিছু একটা জানার সুযোগ পায়, শেখার সুযোগ পায়!
চমৎকার! রুহান নিজের অজান্তেই ক্রিটিনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি ঠিক এরকম একটা কিছু চাচ্ছিলাম!
ক্রিটিনা বলল, তাহলে তুমি আমাকে কখন শেখাবে?
এখনই শেখাব।
এখন? এই লরির মধ্যে? যখন আমরা ঝাঁকুনি খেতে খেতে যাচ্ছি?
হ্যাঁ। ভালো কাজে দেরি করতে হয় না।
সত্যি সত্যি রুহান ক্রিটিনাকে বর্ণমালা শেখাতে শুরু করে দিল।
দুজনে মিলে যখন বর্ণমালার মাঝামাঝি গিয়েছে তখন হঠাৎ লরিটি থেমে গেল। রুহান মাথা বের করে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
সামনে থেকে এজেন্ট দ্রুচান বলল, রাস্তার মাঝখানে দুইটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অনেক মানুষ অনেক অস্ত্র।
রুহানের পেটের মধ্যে কেমন যেন পাক খেয়ে ওঠে, চাপা গলায় বলল, সর্বনাশ!
তাড়াতাড়ি অস্ত্রটা নিয়ে সে লাফিয়ে নেমে আসে। এজেন্ট দ্রুচান চোখে বাইনোকুলার দিয়ে সামনের গাড়িগুলোকে দেখছে। তার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। রুহান জানতে চাইল, কী অবস্থা?
বুঝতে পারছি না।
সবাই কী পজিশান নিয়েছে?
নাহ্। হাঁটাহাটি করছে। দেখে মনে হয় না কোনো খারাপ উদ্দেশ্য আছে। সবাই গল্পগুজব করছে।
তাহলে কী আমরা যাব?
এজেন্ট দ্রুচান বাইনোকুলার থেকে চোখ নামিয়ে বলল, একসাথে সবার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি যাই দেখে আসি কী ব্যাপার।
এজেন্ট দ্রুচান খুব দুশ্চিন্তিত মুখে গেল কিন্তু সে যখন ফিরে এলো তখন তার মুখ ভরা হাসি। হাত নেড়ে চোখ বড় বড় করে বলল, তোমরা বিশ্বাস করবে না কী হচ্ছে?
কী হচ্ছে?
দুই গাড়ি বোঝাই লোকজন, আমাদের সাথে যোগ দেবার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে।
রুহান চোখ কপালে তুলে বলল, তুমি ওদের বলেছ যে আমরা ডাকাতের দল তৈরি করছি না। লুটপাট করতে যাচ্ছি না?
আমার বলতে হয়নি! ওরা জানে। ওরা সেটা জেনেই এসেছে। ওরা ডাকাতের দলে যেতে চায় না।
রিদি অবাক হয়ে বলল, সত্যি?
সত্যি! তোমরা বিশ্বাস করবে না কী ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র নিয়ে চলে এসেছে। যদি আমরা সত্যি সত্যি ডাকাতের দল করতাম, আমাদের সাথে কেউ পারত না!
রুহান চোখ পাকিয়ে বলল, এজেন্ট দ্রুচান, তোমার যতই ডাকাতের দল করার ইচ্ছে হোক না কেন আমরা কিন্তু সেটা করছি না!
এজেন্ট দ্রুচান একটা কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাসের ভঙ্গি করে বলল, আমি জানি রুহান! আমি সেটা খুব ভালো করে জানি।
ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে হলো কেউই বুঝতে পারল না, কিন্তু সবাই যখন ক্রিটিনাদের গ্রামে পৌঁছাল তখন তাদের সাথে আঠারোটা লরি এবং প্রায় তিনশত মানুষ। বেশিরভাগ সশস্ত্র—সবাই এসেছে রুহান আর রিদির সাথে কাজ করার জন্যে। ক্রিটিনার গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেশ রাত হয়ে গেল। কিন্তু তারা দেখল গ্রামের কেউ ঘুমায় নি, সবাই গভীর আগ্রহ নিয়ে তাদের জন্যে। অপেক্ষা করছে। ক্রিটিনাকে দেখে তার মা ছুটে এলো, বুকে জড়িয়ে বলল, মা তুই ফিরে এসেছিস?