গ্রাউসের বয়স রুহান থেকে খুব বেশি নয় কিন্তু তাকে অনেক বেশি বয়স্ক দেখায়। সে লম্বা এবং চওড়া, তার পেশীবহুল শক্ত দেহ, সোনালি চুল এবং নীল চোখ। গাউস সুদর্শন কিন্তু কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে তাকে দেখলে তার সুদর্শন চেহারাটুকু চোখে না পড়ে নিষ্ঠুর ভঙ্গিটুকু প্রথমে চোখে পড়ে।
রুহানকে ঢুকতে দেখে গ্রাউস ক্রুদ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এখানে কী করতে এসেছ?
আমি এদিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। তোমাদের কথা শুনে এসেছি।
আমাদের কথা শুনে তোমার আসার কোনো প্রয়োজন নেই। গ্রাউস চোখ লাল করে বলল, তুমি যেখানে যাচ্ছিলে সেখানে যাও।
গ্রাউসের কথা শুনে রুহান একই সাথে এক ধরনের ক্রোধ এবং অপমান অনুভব করে। সে শীতল গলায় বলল, এটি কিসিমাদের বাসা। আমি এখানে থাকব না চলে যাব সেটি বলবে কিসিমা–তুমি নয়।
গ্রাউস হিংস্র পশুর মতো একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার বেশি সাহস হয়েছে, তাই না?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, না। আমার মোটেও সাহস বেশি হয় নি। তারপর মাথা ঘুরিয়ে কিসিমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে কিসিমা? এয়িনা কাঁদছে কেন?
কিসিমার মুখে এক ধরনের হতচকিত ভাব, দেখে মনে হয় একটা কিছু বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, গ্রাউস বলছে তার ত্রায়িনাকে দরকার।
রুহান চমকে উঠে গ্রাউসের মুখের দিকে তাকাল। গ্রাউসের মুখটি হঠাৎ আরো কঠোর হয়ে যায়। গলা উঁচিয়ে বলল, বলেছিই তো। বলেছি তো কী হয়েছে?
রুহান তীক্ষ্ণ চোখে গ্রাউসের দিকে তাকিয়ে বলল, এটা তুমি কী বলছ। গ্রাউস?
গ্রাউস হঠাৎ হাত দিয়ে রুহানের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল, তুমি কোথাকার মাস্তান, আমাকে উপদেশ দিতে এসেছ?।
রুহান পড়ে যেতে যেতে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে গ্রাউসের দিকে তাকাল। গ্রাউস হিংস্র মুখে বলল, রুহান, তুমি আমার সাথে লাগতে এসো না। তোমাকে আমি শেষ করে দেব।
রুহান তীক্ষ্ণ চোখে গ্রাউসের দিকে তাকিয়ে বলল, কাউকে শেষ করে দেয়া এত সহজ নয় গ্রাউস।
গ্রাউস হিংস্র মুখে বলল, তুমি দেখতে চাও?
না, আমি দেখতে চাই না। কিন্তু আমাদের গ্রামটি এখনো জঙ্গল হয়ে ওঠে নি যে যার যেটা ইচ্ছা সে সেটা করতে পারবে।
গ্রাউস এবারে শব্দ করে হেসে উঠে বলল, রুহান, তাহলে নতুন জীবনের জন্যে প্রস্তুত হও। তোমার প্রিয় গ্রামটাতে এখন নতুন পৃথিবীর নিয়ম আসতে যাচ্ছে।
তুমি কী বলতে চাইছ?
আমি বলতে চাইছি আমার যেটা ইচ্ছা আমি সেটা করব।
রুহান মাথা নেড়ে বলল, না। আমরা সবাই মিলে কিছু নিয়ম ঠিক করেছি
রুহানকে কথা শেষ করতে না দিয়ে গ্রাউস বলল, ঐ সব মান্ধাতা আমলের নিয়মের দিন শেষ। নতুন পৃথিবীতে এখন নতুন নিয়ম।
সেই নিয়মটা কী?
যার ক্ষমতা আছে তার ইচ্ছাটাই হচ্ছে নিয়ম।
রুহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে গ্রাউসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যি সত্যি কেউ এরকম একটি কথা বলতে পারে সে নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করত না। খানিকক্ষণ নিঃশব্দে গ্রাউসের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার ক্ষমতা আছে?
আছে।
তোমার ইচ্ছাটি তাহলে নিয়ম?
হ্যাঁ।
রুহান একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, এখন তোমার ইচ্ছে কিসিমার ছোট মেয়ে ত্রায়িনাকে তুলে নিয়ে যাবে?
গ্রাউস মুখে একটা অশালীন ভঙ্গি করে বলল, সে মোটেই ছোট মেয়ে নয়। সে যথেষ্ট বড় হয়েছে।
বেশ। রুহান হঠাৎ করে নিজের ভেতরে এক ধরনের অদম্য ক্রোধ অনুভব করে। সে দাতে দাঁত ঘষে বলল, দেখি তাহলে তুমি কেমন করে ত্রায়িনাকে তুলে নিয়ে যাও। রুহান দুই পা এগিয়ে কিসিমা আর ত্রায়িনার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, এসো।
গ্রাউস কয়েক মুহূর্ত স্থির চোখে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, কাজটা ভালো করলে না রুহান।
রুহান কোনো কথা না বলে স্থির চোখে গ্রাউসের দিকে তাকিয়ে রইল। গ্রাউস হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে চলে যেতে শুরু করে, গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ঘুরে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, এর জন্য তোমাকে মূল্য দিতে হবে রুহান।
রুহান নিচু গলায় বলল, দেব।
অনেক মূল্য।
দেব।
গ্রাউস চলে যাবার পর রুহান মাথা ঘুরিয়ে কিসিমা আর তার মেয়ে ত্রায়িনার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা ভেতরে যাও, অনেক রাত হয়েছে।
কিসিমা ভাঙ্গা গলায় বলল, তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব রুহান-
এখানে ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই।
ত্রায়িনা ফেঁপাতে ফোঁপাতে বলল, যদি আবার আসে?
আসবে না। তোমরা ভালো করে দরজা বন্ধ করে রেখ। আমি ভোরবেলা সবার সাথে কথা বলব। ভয় পাবার কিছু নেই।
ত্রায়িনা বড় বড় চোখে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যি?
হ্যাঁ। সত্যি–কথা বলবে গিয়ে রুহানের গলা কেঁপে উঠল, কারণ সে জানে কথাটি আসলে সত্যি নয়। নতুন পৃথিবীতে সবকিছু পাল্টে গেছে, এখন কোথাও কোনো নিয়ম নেই। এখানে যার শক্তি বেশি, যার ক্ষমতা বেশি তার ইচ্ছেটাই হচ্ছে নিয়ম। ঠিক গ্রাউস যেভাবে বলেছে।
খাবার টেবিলে মা বলল, রুহান এত রাত করে ফিরেছিস! দিন কাল ভালো না জানিস না?
রুহান প্লেটের শুকনো রুটিটা পাতলা স্যুপে ভিজিয়ে নরম করে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, কেন মা? দিন কাল নতুন করে আবার খারাপ হলো কেন?
দেখছিস না কী হচ্ছে? যার যা খুশি সেটা করা শুরু করেছে।
মা কী নিয়ে কথা বলছে রুহান সেটা ভালো করে জানে। পৃথিবীর এক এলাকার সাথে এখন অন্য এলাকার কোনো যোগাযোগ নেই, প্রত্যেকটা এলাকা। এখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো কোনোভাবে টিকে আছে। কোথাও কোথাও পরিবেশ একেবারে নারকীয় কোথাও কোথাও সবাই মিলে এখনো মোটামুটি শান্তিতে বেঁচে আছে।