কী?
এটা একটা কাচের ঘর, ভেতরে ঠাণ্ডা কিন্তু বাইরে গরম।
তার মানে কী?
মানমন্দিরের কাচ সূর্যের আলোর তাপের অংশটিকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না, এটা বাইরে প্রতিফলিত হচ্ছে, সেজন্য বাইরে গরম। শুধু দৃশ্যমান আলোটা ঢুকতে দিচ্ছে ভিতরে, সেজন্যে ভেতরে অনেক আলো কিন্তু গরম নেই, ঠাণ্ডা।
ভারি মজা তো।
হ্যাঁ। এলাকটা নিশ্চয়ই উষ্ণ। মানমন্দিরকে ঠাণ্ডা রাখার জন্যে এরকম কাচ লাগানো হয়েছে।
ঠিকই বলেছ।
রুহান আর ক্রিটিনা কথা বলতে বলতে মানমন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যেতে থাকে। অনেক উঁচু মানমন্দির, ছাদে পৌঁছানোর পর তারা আবিষ্কার করল এখানে দাঁড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। যে রাস্তা ধরে তারা এসে সেই রাস্তাটি পাহাড়কে ঘিরে ঘুরে ঘুরে নেমে গেছে। চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে তারা প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। রুহান চারদিকে তাকিয়ে দেখে–যতদূর দেখা যায়, ফাঁকা ধূ ধূ পাহাড়, জনমানবের চিহ্ন নেই। পুরো দৃশ্যটাতে এক ধরনের মন খারাপ করা বিষয় রয়েছে, ঠিক কী কারণে মন খারাপ হয় সেটা বুঝতে না পেরে রুহান এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে।
মানমন্দিরের ছাদে দাঁড়িয়ে তারা দেখতে পায় ছেলেমেয়েগুলো বাইরে ছুটোছুটি করছে। এখন তাদের দেখে বোঝাই যায় না যে সবাইকে মায়ের বুক থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পণ্য হিসেবে বিক্রি করার জন্যে। মনে হচ্ছে তারা বুঝি কোথাও পিকনিক করতে এসেছে।
মানমন্দিরের ছাদে দুজন ইতস্তত হাঁটে। চারপাশে বন জঙ্গল। এখানে জনবসতি কখনোই ছিল না, এক সময় হয়তো মানমন্দিরটা চালু ছিল তখন কিছু মানুষজন থাকত, আসত-যেত। এখন কেউ নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞানে এখন মানুষের কোনো আগ্রহ নেই, উৎসাহ নেই।
রুহান–ক্রিটিনার গলার স্বর শুনে রুহান ঘুরে তাকাল। ক্রিটিনা বলল, তোমাকে আমার একটা কথা বলা হয়নি।
কী কথা?
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
রুহান হেসে বলল, কী জন্যে ধন্যবাদ?
আমাদের উদ্ধার করে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছ, সেজন্যে নয়। সেজন্যে কৃতজ্ঞতা। কিন্তু ধন্যবাদ অন্য কারণে–
কী কারণে?
এই যে আমি তোমাকে বলছি তোমাকে অনেক ধন্যবাদ—এই কথাটি বলার সুযোগ করে দেবার জন্যে। এরকম কথা বলাই আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে পৃথিবীটা হচ্ছে স্বার্থপর নিষ্ঠুর একটা জায়গা। এখানে সবাইকে হতে হবে হিংস্র আর স্বার্থপর। যার যেটা প্রয়োজন সেটা কেড়ে নিতে হবে। এখানে ভালোবাসা আর মমতার কোনো স্থান নেই।
ক্রিটিনা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমিও একজন হিংস্র মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালে সেটা ভুল। তুমি আবার আমার ভিতরে মানুষের উপরে বিশ্বাস ফিরিয়ে নিয়ে এসেছ। এই বিশ্বাসের কারণে আমি হয়তো খুব বিপদে পড়ব। হয়তো আমার দুঃখ হবে, কষ্ট হবে, যন্ত্রণা হবে, কিন্তু তবু আমি এই বিশ্বাসটা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।
কথা বলতে বলতে ক্রিটিনা দূরে তাকাল এবং হঠাৎ করে তার চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে যায়। সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, রুহান!
কী হয়েছে?
ঐ দেখ–
রুহান ক্রিটিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে দূরে তাকায়, বহুদূরে পাহাড় ঘিরে রাস্তাটি উঠে এসেছে। সেই রাস্তায় অনেকগুলো গাড়ি একটা কনভর। গাড়িগুলো এইদিকে আসছে। ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যে এগুলো এখানে পৌঁছে যাবে।
কেউ বলে দেয়নি কিন্তু তারা জানে এই কনভয়গুলো আসছে তাদের ধরে নেয়ার জন্যে।
১১. এজেন্ট দ্রুচান
এজেন্ট দ্রুচান বলল, না, আমি এক ঘণ্টার ভেতর রওনা দিতে পারব না। এখনো সবগুলো কুলেন্ট টিউব ওয়েল্ড করে লাগানো হয়নি। সময় লাগবে।
রিদি গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, তাহলে আমাদের করার বিশেষ কিছু নেই। কনভয়টাকে মাঝখানে থামাতে হবে।
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, অস্ত্র নিয়ে আমরা মাত্র দুইজন। ক্রিটিনাকে ধরলে তিনজন। তাদের গাড়িই আছে চারটা। কিছু একটা করা যাবে বলে মনে হয় না।
রাস্তার ভালো একটা জায়গা দেখে এমবুশ করতে হবে। রিদি বলল, প্রথম গাড়িটা থামাতে পারলে অন্যগুলোও থেমে যাবে।
রুহান কোনো কথা না বলে অন্যমনস্কভাবে মাথা ঘুরিয়ে দূরের মানমন্দিরটার দিকে তাকাল। রিদি বলল, তাহলে দেরি করে কাজ নেই, চলো
এখনই বের হয়ে পড়ি।
রুহান বলল, আমি অন্য একটি কথা ভাবছিলাম।
কী কথা?
ঐ যে মানমন্দিরটা দেখছ, তার কাচগুলো তাপ প্রতিরোধক। সূর্যের আলোর ভেতর যেটুকু দৃশ্যমান সেটা ঢুকতে দেয় কিন্তু তাপের অংশটুকু প্রতিফলিত করে দেয়। আমরা এই কাচগুলো ব্যবহার করে একটা কাজ করতে পারি।
কী কাজ?
আমাদের মধ্যে প্রায় তিরিশজন ছেলে-মেয়ে আছে। সবার কাছে যদি একটা কাচ দিই তারা সেটা হাতে নিয়ে সূর্যের আলোটা প্রতিফলিত করে ঐ গাড়িগুলোর উপরে ফেলে তাহলে গাড়িগুলোতে আগুন ধরে যাবে। আমরা অনেক দূর থেকে গাড়িগুলো জ্বালিয়ে দিতে পারব।
রিদি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে বলল, সত্যি?
কয়েক হাজার বছর আগে আর্কিমিডিস নামে একজন বিজ্ঞানী এভাবে শত্রুদের জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন।
তুমিও সেটা করবে?
হ্যাঁ। একটু প্র্যাকটিস করতে হবে, কিন্তু আমার মনে হয় আমরা পারব। সবচেয়ে বড় কথা কাজটা করা যাবে গোপনে, তারা বুঝতেই পারবে না কী হচ্ছে।
রিদি বলল, ঠিক আছে, তাহলে দেরি করে লাভ নেই। কাজ শুরু করে দেয়া যাক।
মানমন্দিরের কাচগুলো খুলে নেয়ার কাজটুকু সহজ হলো না, কিন্তু কাচগুলো অক্ষত রেখে খোলারও প্রয়োজন ছিল না তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় বড় গোটা চল্লিশেক কাচ খুলে ফেলা হলো। সূর্যটা এতক্ষণে বেশ উপরে উঠে তার প্রখর আলোতে এখন যথেষ্ট উত্তাপ। বড় কাচগুলো দিয়ে তার প্রায় সবখানি প্রতিফলিত করা যায়।