তোমাদের নিরাপত্তা দেবার কেউ নেই–এই লোক ক্ৰিভনের খুব কাছের মানুষ। কিছুক্ষণের মধ্যে লোকজন আসবে তোমাদের ধরতে।
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমারও তাই ধারণা।
তোমাদের এক্ষুনি সরে পড়তে হবে। এই মুহূর্তে।
ঠিকই বলেছ।
কীভাবে পালাবে এখান থেকে?
আমরা ভাবছিলাম তুমি আমাদের নিয়ে যাবে।
আমি? এজেন্ট দ্রুচান অবাক হয়ে বলল, আমি কেন নিয়ে যা যেখানে এক ইউনিট কমিশন নেই সেখানে আমি কেন তোমাদের নিয়ে যাব?
রুহান এজেন্ট দ্রুচানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি নিয়ে যা। কারণ সেটা হবে এই হতভাগ্য মানুষগুলোকে সাহায্য করার একটা সুযোগ। তুমি তাদের সাহায্য করবে।
এজেন্ট দ্রুচান অবাক হয়ে রুহানের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে শব্দ করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে যায়, চোখ মুছে নিজেকে। সামলে নিয়ে বলল, তুমি খুব মজার মানুষ। আমি বিশ্বাস করতে পারি না। কেউ একজন তোমার মতো করে কথা বলতে পারে।
রুহান বলল, আমি এমন কিছু বিচিত্র কথা বলি নি। পৃথিবীটা গড়ে উঠে মানুষের জন্যে মানুষের ভালোবাসার কারণে। তুমি যদি এই মানুষগুলো সাহায্য করো তাহলে সেই ভালোবাসাটা অনুভব করতে পারবে। মানুষের জন্যে। ভালোবাসার মতো সুন্দর জিনিস পৃথিবীতে আর কিছু নেই! বিশ্বাস করো।
এজেন্ট দ্রুচান এক ধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে বলল, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না যে তুমি আমাকে এসব বলছ।
রুহান বলল, তুমি বিশ্বাস করবে কী না, সেটা তোমার ব্যাপার। কি আমি যেটা বলছি সেটা সত্যি বলছি।
এজেন্ট দ্রুচান মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, আমি গেলাম। তোমরা কী করবে তোমরাই জান। আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি যে তোমরা যদি এখনই এখান থেকে সরে না পড়ে তোমাদের কপালে দুঃখ আছে। অনেক বড় দুঃখ।
এজেন্ট দ্রুচান চলে যাবার পর রিদি রুহানের সামনে দাঁড়িয়ে বল, তাহলে কী করবে ঠিক করেছ?
আপাতত সরে পড়ি।
কোথায় সরে পড়বে?
পাহাড়ের দিকে যাই। জঙ্গলে ঢুকে পড়ি–সেখানে চট করে কেউ খুঁওে পাবে না।
রিদি মাথা নাড়ল, খুব ভালো একটা পরিকল্পনা হলো বলে মনে হচ্ছে না কিন্তু আর তো কিছু করার নেই। রিদি জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, চল তাহলে রওনা দিই।
ঘণ্টাখানেক পরে পাহাড়ী পথে রুহান আর রিদি জনা ত্রিশেক নানা বয়সের তরুণ-তরুণী নিয়ে হেঁটে যেতে থাকে। আবছা অন্ধকার, আকাশে একটা ভাঙ্গা দ, তার মৃদু আলোতে সবাই নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে। ছোট একটা উপত্যকা পার হলে তারা একটা পাহাড়ী রাস্তায় উঠতে পারবে। এই রাস্তা ধরে দক্ষিণে কয়েকশ কিলোমিটার যেতে হবে। কেমন করে যাবে তারা এখনো জানে না।
উপত্যকাটা পার হয়ে তারা পাহাড়ী রাস্তায় এসে ওঠে। কম বয়সী ছেলেমেয়েগুলো পথের পাশে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে। আবছা অন্ধকারে তাদের চেহারা দেখা যায় না, শুধু ভাগ্যের উপর অসহায়ভাবে সবকিছু অসমর্পণ করে দেয়ার ভঙ্গিটুকু বোঝা যায়।
রুহান নিচু গলায় বলল, তোমরা বিশ্রাম নেবার জন্যে খুব বেশি সময় পাবে না। আমাদের এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে যেতে হবে।
অন্ধকারে বসে থাকা একজন তরুণ জিজ্ঞেস করল, কেন?
তোমাদের যাদের কাছ থেকে ছুটিয়ে এনেছি তারা তোমাদের আবার ধরে–তে আসতে পারে।
অন্ধকারে বসে থাকা তরুণটি বলল, তাতে কী আসে যায়? আমরা তোমাদের হাতে থাকি আর অন্যের হাতে থাকি তাতে কী আসে যায়?
রুহান কী উত্তর দেবে বুঝতে পারে না। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন অনেক দূরে একটা লরির হেডলাইট দেখতে পেল।
রিদি নিচু গলায় বলল, সবাই পিছনে সরে যাও। বনের ভেতরে গিয়ে লুকিয়ে যাও।
আবছা অন্ধকারে বসে থাকা তরুণটি বলল, কেন? কেন আমাদের পিছনে সরে যেতে হবে?
কারা আসছে আমরা জানি না। তারা কী চায় সেটাও জানি না। যদি গোলাগুলি শুরু হয় তোমাদের নিরাপদে থাকা দরকার। মাথা নিচু করে মাটিতে শুয়ে থাক। যাও।
আবছা অন্ধকারে বসে থাকা তরুণ-তরুণীগুলো উঠে দাঁড়িয়ে হুঁটোপুটি করে বনের ভেতরে ছুটে যেতে থাকে। রিদি আর রুহান দুটি বড় গাছের মড়ালে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা লরিটির ইঞ্জিনের চাপা গুঞ্জন শুনতে পেল। দেখতে দেখতে সেটা তাদের কাছাকাছি চলে আসে। রিদি আর রুহান অবাক হয়ে দেখল তাদের কাছাকাছি এসে লরিটি থেমে যায়। তারা ভাবছিল লরির পিছন থেকে অস্ত্র হাতে অনেকগুলো মানুষ নামবে কিন্তু সেরকম কিছু হলো। তারা অবাক হয়ে দেখল শুধু ড্রাইভিং সীট থেকে একজন মানুষ নেমে এলে। আবছা অন্ধকারে তাকে স্পষ্ট দেখা যায় না, চোখে লাগানো ইফ্রারেড গগলসটা শুধু চোখে পড়ে। মানুষটি এদিকে সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ উচ্চস্বরে ডাক, রুহান, রিদি–
রুহান আর রিদি মানুষটির গলার স্বর চিনতে পারে, এজেন্ট দ্রুচান। গাছে। আড়াল থেকে দুজনে বের হয়ে এলো, রুহান বলল, কী ব্যাপার দ্রুচান? তুমি এখানে?
এজেন্ট দ্রুচান বলল, তোমার মানুষজন কোথায়? দেরি করো না, তাড়াতাড়ি ওঠো লরিতে। তোমাদের খোঁজে বিশাল বাহিনী রওনা দিচ্ছে।
রুহান এজেন্ট দ্রুচানের কাছে গিয়ে নরম গলায় বলল, আমি জানতাম তুমি আসবে।
এজেন্ট দ্রুচান বিরক্ত গলায় বলল, বাজে কথা বলো না। আমি নিজে জানতাম না আর তুমি কেমন করে জানতে?
তুমি না জানতে পার, কিন্তু আমি জানতাম। এই পৃথিবীটা টিকে যাণে কেন তুমি জান এজেন্ট দ্রুচান?