আমার প্রিয় দর্শকেরা। তোমরা কী এখন এই দুই হিংস্র মানুষ, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ উত্তেজনাময় খেলার খেলোয়াড়দের খেলা দেখতে চাও?
হাজার হাজার মানুষ উন্মত্ত গলায় চিৎকার করে ওঠে দেখতে চাই! দেখতে চাই!!
লাউড স্পীকারে আবার মানুষটির গলা শোনা গেল, তাহলে দেখ! রুহান রুহান এবং রিদি হাজার হাজার মানুষ তোমাদের খেলা দেখতে এসেছে। দেখাও তোমাদের খেলা দেখাও। হত্যা করো একজন আরেজনকে। হত্যা করো। হত্যা—হত্যা–
লাউড স্পীকারে ভয়ঙ্কর একটা বাজনা বেজে হঠাৎ করে সেটি থেমে যায়। রুহানের মনে হয় কোথাও কোনো শব্দ নেই। চারপাশে পাথরের দেয়াল, দেয়ালের উপর সারি সারি বসে থাকা মানুষ সবকিছু কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে যায়। মনে হয় কোথাও কেউ নেই। শুধু বহুঁ দূরে দুই পা অল্প একটু ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ। যে কোনো মুহূর্তে মানুষটি একটা অস্ত্র তুলে নিয়ে তাকে গুলি করবে।
মানুষটি অনেক দূরে, তার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। রুহানের কী হলো কে জানে, হঠাৎ করে এই মানুষটার সত্যিকার চেহারা দেখার একটা অদম্য ইচ্ছে তার বুকের ভেতর জেগে উঠল। যে মানুষটাকে সে হত্যা করবে কিংবা যে মানুষটা তাকে হত্যা করবে, তাকে সে ভালো করে একবার দেখবে না, চোখে চোখে তাকাবে না, সেটা তো হতে পারে না। রুহান তাই এক পা অগ্রসর হলো।
বহুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিও ঠিক এক পা অগ্রসর হলো। কী আশ্চর্য! সে যেরকম মানুষটিকে কাছে থেকে দেখতে যাচ্ছে ঠিক সেরকম এই মানুষটিও তাকে কাছে থেকে দেখতে চাচ্ছে? তার যেরকম কৌতূহল রিদি নামের মানুষটারও কী ঠিক সেই একই রকম কৌতূহল? রুহান তখন আরো এক পা অগ্রসর হয়–রিদি নামের মানুষটাও এক পা অগ্রসর হয়। রুহান হাত দিয়ে মাথা থেকে টুপিটা খুলে নেয়। ডান হাতে টুপিটা ধরে রাখায় আপাতত সেই হাতটি অচল হয়ে গেল। রিদিকে সে এটা জানিয়ে দিতে চায়। সে এই মুহূর্তে ডান হাতে অস্ত্র তুলে নেবে না, ইচ্ছে করলেও পারবে না। রিদিও তার মাথা থেকে টুপিটা খুলে হাতে নেয়। এই মানুষটাও রুহানকে জানাল, সে এই মুহূর্তে তাকে গুলি করবে না। আগে কাছে এসো তোমাকে একবার ভালো করে দেখি।
দুজন দুজনের দিকে হেঁটে যেতে থাকে। পাথরের দেয়ালের উপরে বসে থাকা সারি সারি মানুষের ভেতরে একটা বিস্ময়ধ্বনি শোনা যায়, কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না, দুজন খেলোয়াড় একজন আরেকজনের কাছে এত সহজে এগিয়ে যেতে পারে। নতুন এক ধরনের উত্তেজনার জন্যে সবাই সোজা হয়ে বসে, তাদের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়।
রুহান আর রিদি হেঁটে হেঁটে একজন আরেকজনের খুব কাছাকাছি এসে থামল। এত কাছে যে ইচ্ছে করলে একজন আরেকজনকে স্পর্শ করতে পারে। কিন্তু তারা একজন আরেকজনকে স্পর্শ করল না, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
রিদির মুখে ছোপ ছোপ কালো রং, চেহারায় ভয়ঙ্কর একটি ছাপ দেয়ার চেষ্টা করেছে। রুহান অবাক হয়ে দেখল ছোপ ছোপ কালো রঙের আড়ালে রিদির চেহারায় এক আশ্চর্য সারল্য। চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ, বিষণ্ণ এবং বেদনাতুর। তরুণটি তার দিকে বিস্ময়ে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মনে হয় সে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
রুহান রিদির দিকে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে বলল, আমি পারব।
কী পারবে না?
আমি তোমাকে হত্যা করতে পারব না।
রিদির মুখে বিচিত্র এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে। সে হাসিটাকে ধরে রেখে বলল, চারদিকে তাকিয়ে দেখ, কত মানুষ। তারা সব দেখতে এসেছে তুমি আমাকে কেমন করে হত্যা করবে আর আমি তোমাকে কেমন করে হত্যা করব।
আসুক।
তারা অপেক্ষা করছে।
করুক। তুমি চাইলে আমাকে হত্যা করতে পার। রুহান মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু আমি তোমাকে হত্যা করব না।
তুমি তাহলে কী করবে?
রুহান বলল, আমি জানি না।
তুমি কিছু না করে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। তোমাকে কিছু একটা করতে হবে।
করতেই হবে?
হ্যাঁ। করতেই হবে।
রুহান মাথার টুপিটা পরে বলল, ঠিক আছে, তাহলে কিছু একটা করি।
এর পর সে যে কাজটা করল তার জন্যে রিদি প্রায় হাজার দশেক শ্বাসরুদ্ধ দর্শক এমন কী সে নিজেও প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ করে সে ঘুরে দাঁড়ায়, তারপর পাথরের দেয়ালের দিকে ছুটে যায়। এবড়ো থেবড়ো দেয়াল ধরে সে ক্ষীপ্র সরীসৃপের মতো উপরে উঠে কিছু বোঝার আগে জমকালো পোশাক পরা ক্ৰিভনের মাথার উপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা ধরে।
শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বসে থাকা হাজার দশেক দর্শক বিস্ময়ের এক ধরনের আর্ত শব্দ করে হঠাৎ করে একেবারে নিশ্ৰুপ হয়ে যায়, মনে হয় একটা সূচ ফেললেও বুঝি তার শব্দ শোনা যাবে।
রুহান ফিসফিস করে বলল, ক্ৰিভন! তোমার সেনাবাহিনীকে বলে দাও তারা যদি একটুও বোকামী করে তাহলে তোমার মস্তিষ্কে কমপক্ষে এক ডজন। বুলেট ঢুকে যাবে।
ক্রিভন কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, তুমি কী চাও?
আমি ভালো করে জানি না। রুহান অস্ত্রটা ক্ৰিভনের মাথায় আলতোভাবে স্পর্শ করে বলল, আগে তোমার সেনাবাহিনীর কাছে নির্দেশ পাঠাও, তারা যেন হাতের অস্ত্র নিচে নামিয়ে রাখে। এই মুহূর্তে
ক্ৰিভনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, সে তার পাশে বসে থাকা সামরিক পোশাক পরা একজনকে বলল, জেনারেল, তুমি এক্ষুনি নির্দেশ দাও। এই মুহূর্তে। কেউ যেন কোনো পাগলামী না করে।
চমৎকার! রুহান এবার ক্ৰিভনের বুকের কাপড় টেনে তাকে দাঁড় করিয়ে দেয় তারপর তাকে ঠেলে সামনের দিকে নিয়ে যায়। মাথার পিছনে অস্ত্রটা ধরে রেখে বলল, এবারে আমার সাথে চলো।