রুহান বলল, ঠিক আছে ত্রিনা। আমি এখন কথা বলব না, ত্রিনা।
রুহান অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, প্রতিবার ত্রিনা কথাটা উচ্চারণ করতেই তার ভেতরে কিছু একটা যেন কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে সত্যিই বুঝি সে তার বোনের সাথে কথা বলছে।
ত্রিনা চলে যাবার পর নীল কাপড় পরা চারজন মানুষ তার অস্ত্রগুলো নিয়ে। এলো। তারা সময় নিয়ে অস্ত্রগুলো তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বেল্ট দিয়ে বেঁধে দিতে থাকে। গুলির ম্যাগাজিন ঝুলিয়ে দিতে থাকে। রুহান বলল, আমাকে যত গুলি দিচ্ছ মনে হচ্ছে একজন নয়, একশজনের সাথে যুদ্ধ করব।
মানুষ চারজনের কেউ তার কথার উত্তর দিল না। একটু পরেই যে ঘটনাটি ঘটবে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা–সেটা নিয়ে কেউ হালকা কিছু বলতে চায় না। বলার সাহস পায় না। রুহানকে অস্ত্র দিয়ে সাজিয়ে দেবার পর তারা তাকে সামনে হাঁটিয়ে নিতে থাকে। তখন রুহান প্রথমবার অসংখ্য মানুষের কলরব শুনতে পায়। তার সাথে সাথে লাউড স্পীকারে একজন মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। একজন মানুষ চিৎকার করে কিছু একটা বলছে–গলার স্বরে উত্তেজনা। কী বলছে স্পষ্ট করে বুঝতে পারছে না শুধুমাত্র কণ্ঠস্বরে প্রায় উন্মত্ততার কাছাকাছি উত্তেজনাটুকু ধরা পড়ছে।
রুহান পাশের মানুষটিকে জিজ্ঞেস করল, কী বলছে ওখানে?
তোমার কথা।
আমার কথা?
হ্যাঁ।
আমার কী কথা?
তুমি কী ভয়ঙ্করভাবে আজকে তোমার প্রতিপক্ষকে হত্যা করবে, এইসব।
রুহান একটু অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকাল। সত্যিই কী তাই বলছে? সত্যিই কী এই ধরনের কথা বলা যায়? বলা সম্ভব?
হঠাৎ হাজার হাজার মানুষের চিৎকার শোনা যায়। রুহান মাথা ঘুরিয়ে পাশের মানুষটিকে জিজ্ঞেস করল, সবাই চিৎকার করছে কেন?
তোমার প্রতিপক্ষ এইমাত্র মাঠে এসেছে। সবাই তাকে অভিনন্দন। জানাচ্ছে। তুমি যখন যাবে, তখন তোমাকেও এভাবে অভিনন্দন জানাবে।
আমি কখন যাব?
এই তো এক্ষুণি যাবে। যখন তোমাকে ডাকবে।
হঠাৎ করে রুহান নিজের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে। কিছুক্ষণের মধ্যে যে ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে সে তার জন্যে আর অপেক্ষা করতে পারছে না। এটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ হয়ে যাক–সে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে পারবে না। রুহানের নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়ে আসে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাস জমে ওঠে। সমস্ত শরীর টান টান হয়ে থাকে উত্তেজনায়।
ঠিক এরকম সময়ে পাশে দাঁড়ানো মানুষটি বলল, চল। তোমাকে ডাকছে।
রুহান কোনো কথা না বলে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। সামনে একটা বড় স্টেনলেস স্টীলের গেট। কাছাকাছি আসতেই সেটা নিঃশব্দে খুলে গেল, সাথে সাথে সে বাইরে অসংখ্য মানুষের গুঞ্জন শুনতে পেল। লাউড স্পীকারে মানুষটির কথা হঠাৎ করে স্পষ্ট হয়ে যায়। গমগমে উত্তেজিত গলায় একজন বলছে, তোমরা যারা নিঃশ্বাস বন্ধ করে নিষ্ঠুর একটা হত্যাকারীকে দেখার জন্যে ধৈর্য ধরে বসে আছ, সে আসছে। সে তোমাদের সামনে আসছে। এই ভয়ঙ্কর রক্তপিপাসু হিংস্র মানুষটি হচ্ছে রুহান রুহান!
রুহান খোলা গেট দিয়ে হেঁটে বাইরে মাঠে এসে দাঁড়ায়, চারপাশে পাথরের দেয়াল, তার উপরে বসার জায়গা সেখানে হাজার হাজার মানুষ বসে আছে। তাকে দেখে তারা আনন্দে চিৎকার করতে থাকে। রুহানের এখনো বিশ্বাস হয় না, এই হাজার হাজার মানুষ একটা হত্যাকাণ্ড দেখতে এসেছে? কে কাকে হত্যা করতে পারে সেই ভয়ঙ্কর খেলার দর্শক এরা? এরা কী মানুষ? মানুষ কী এই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড দেখে আনন্দ পেতে পারে? পাওয়া সম্ভব?
রুহান হাজার হাজার মানুষের চিৎকার আর আনন্দধ্বনি শুনতে শুনতে চারদিকে তাকাল। তখন সে মাঠের অন্য পাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখতে পেল। মাঠটি অনেক বড়, মানুষটি অনেক দূরে পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার চেহারাটি ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। না দেখেও সে বুঝতে পারে মানুষটির মুখমণ্ডল নিশ্চয়ই পাথরের মতো শক্ত, চোখের দৃষ্টি কুর। রুহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটি তাকে হত্যা করবে নাকি সে এই মানুষটিকে হত্যা করবে?
হঠাৎ করে আবার সে লাউড স্পীকারে একজন মানুষের গমগমে গলার স্বরে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়। মানুষটি উন্মত্তের মতো চিৎকার করে বলে, তোমরা সবাই যে খেলাটি দেখার জন্যে শত শত কিলোমিটার দূর থেকে এসেছ, এক্ষুণি সেই খেলাটি দেখবে। এই খেলা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ খেলা। এই খেলা হচ্ছে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ মানুষকে হত্যা করার খেলা!
বিশাল মাঠের চারপাশে বসে থাকা অসংখ্য মানুষ এক ধরনের আনন্দধ্বনি করে ওঠে।
মানুষটির উত্তেজিত কণ্ঠস্বর আবার গমগম করে ওঠে, এই বিশাল আনন্দ মেলায় সবাইকে স্বাগতম। আজকের এই খেলা যিনি আয়োজন করেছেন, এই অঞ্চলের সেই অলিখিত সম্রাট, যুদ্ধবাজ নেতা সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনীর অধিনায়ক বীর সাহসী যোদ্ধা ক্ৰিভনকে সবার পক্ষ থেকে অভিনন্দন।
রুহান দেখতে পেল একেবারে সামনের সারিতে বসে থাকা জমকালো পোশাকে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ উঠে দাঁড়াল, উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ চিৎকার করে তাকে অভিনন্দন জানাল। ক্ৰিভন হাত নেড়ে সবার অভিবাদনের প্রত্যুত্তর দেয় তারপর আবার নিজের জায়গায় বসে যায়।
লাউড স্পীকারে গমগমে গলায় মানুষটি বলে, তোমরা সবাই দেখেছ, মাঠের উত্তর পাশে দাঁড়িয়ে আছে রুহান রুহান। ভয়ঙ্কর হিংস্র রুহান রুহান। মাঠের দক্ষিণ পাশে দাঁড়িয়ে আছে রিদি-নিষ্ঠুর রক্তপিপাসু রিদি।