রুহান বুঝতে পারছিল পাহাড়ের কাছাকাছি এই ট্রেনিং সেন্টার থেকে তার বিদায় নেবার সময় চলে আসছে। একজন মানুষকে যতটুকু শেখানো সম্ভব মোটামুটি সবই তাকে শেখানো হয়েছে। এখন তাকে কোনো একটি সত্যিকার খেলায় নামিয়ে দিতে হবে। যেখানে সে মুখোমুখি দাঁড়াবে একজন সত্যিকার মানুষের সামনে, যে মানুষটি হবে ঠিক তার মতো একজন খেলোয়াড়। ঠিক তার মতোই ক্ষীপ্র, তার মতোই মানুষকে হত্যা করার জন্যে প্রস্তুত।
তাই একদিন ভোরবেলা যখন ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করল তার ঘরের ভেতর চারজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারল সে যে সময়ের জন্যে অপেক্ষা করছে সেই সময়টুকু চলে এসেছে।
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলল, রুহান, তোমার এখন আমাদের সাথে যেতে হবে।
কোথায় শব্দটি উচ্চারণ করতে গিয়ে রুহান থেমে গেল। জিজ্ঞেস করে কী হবে? রুহান শান্ত গলায় বলল, এখানে আমার সাথে অনেকের পরিচয় হয়েছে। আমি কী তাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারি?
না। মানুষটি শীতল গলায় বলল, তোমাকে আমরা খেলোয়াড় হিসেবে তৈরি করেছি। বিদায় নেয়ার মতো ছেলেমানুষী মানবিক বিষয়গুলো তোমার ভেতরে থাকার কথা নয়। তোমাকে বুঝতে হবে, তুমি হবে বোধশক্তি ভালোবাসাহীন একটা ক্ষীপ্র যন্ত্র।
রুহান মাথা নেড়ে বলল, ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেবার জন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
মানুষটি হাসিমুখে মাথা নাড়ল, রুহানের বিদ্রুপটুকু ধরতে পারল না।
এবারে একজন একটা কালো কাপড় নিয়ে এলো। বলল, তোমার চোখ দুটো বেঁধে নিতে হবে রুহান।
রুহান একবার ভাবল সে জিজ্ঞেস করবে, কেন আমার চোখ বেঁধে নিতে হবে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল না। কী হবে জিজ্ঞেস করে?
চোখ বাঁধা অবস্থায় রুহানকে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন সে কিছু দেখতে না পেয়েও বুঝতে পারছিল হল ঘরে অপ্রকৃতস্থ কিছু তরুণ-তরুণী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কিছু বলছে না কিন্তু তারপরেও সে অনুভব করল তারা বুঝি ফিসফিস করে বলছে, বিদায়। বিদায়। রুহান রুহান।
০৭. মেয়েটি রুহানের থুতনি ধরে
মেয়েটি রুহানের থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে বলল, ইশ! তোমার চেহারাটা কি মিষ্টি! দেখে মনেই হয় না যে তুমি এত বড় খুনি।
রুহান কিছু বলল না। সে কী আসলেই খুব বড় খুনি? মেয়েটা তার মুখটা ডান থেকে বামে নাড়িয়ে বলল, এরকম মিষ্টি চেহারার মানুষ হয়ে তুমি মানুষ খুন করার খেলোয়াড় হলে কেমন করে?
রুহান এবারেও কিছু বলল না। মেয়েটা হাতে খানিকটা কালো রং নিয়ে রুহানের চিবুকের নিচে লাগিয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। রুহান বলল, তুমি কী করছ? আমার মুখে রং লাগাচ্ছ কেন?
তোমার মুখে একটু নিষ্ঠুর ভাব আনার চেষ্টা করছি। চোয়ালের হাড় উঁচু থাকলে মানুষকে নিষ্ঠুর দেখায়। চোখটাও গভীরে ঢোকাতে হবে। চুলগুলো আরো ছোট করে ছাটতে হবে।
কেন? আমাকে এরকম নিষ্ঠুর দেখাতে হবে কেন? আমাকে যে কাজে ব্যবহার করছ সেটা কী যথেষ্ট নিষ্ঠুর না?
সেজন্যেই তো এটা জরুরি। একটা নিষ্ঠুর কাজে যাচ্ছে একজন মানুষ, তার চেহারাটা যদি ছোট শিশুর মতো কোমল হয় তাহলে কেমন করে হবে?
মেয়েটা তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখের নিচে খানিকটা রং লাগিয়ে মাথা বাঁকা করে তাকে দেখল। তারপর মাথা নাড়িয়ে বলল, নাহ্। তোমার চেহারায় নিষ্ঠুরতা ঠিক আসছে না।
রুহান বলল, ছেড়ে দাও। আমি হয়তো আর ঘণ্টাখানেক বেঁচে আছি। এখন কী এগুলো ভালো লাগে?
মেয়েটা হাত দিয়ে পাশের টেবিলে ঠোকা দিয়ে বলল, কাঠে ঠোকা। কাঠে ঠোকা। অপয়া কথা বল না। ঘণ্টাখানেক বলছ কেন? তুমি অনেকদিন বেঁচে থাকবে। সব খেলোয়াড়কে খুন করে তুমি হবে খেলোয়াড়দের খেলোয়াড়। হাজার ইউনিট দিয়ে মানুষ তখন তোমার খেলা দেখতে আসবে।
রুহান কোনো কথা বলল না। তার ভেতরে সে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে। পাথরের দেয়ালে ঘেরা একটা মাঠের মধ্যে কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে, সেখানে থাকবে ঠিক তার মতো একজন মানুষ হত্যা করতে যার এতটুকু দ্বিধা নেই, শিকারিরা যেভাবে পাখিকে গুলি করে ঠিক সেভাবে গুলি করবে সে। চারপাশে থাকবে হাজার হাজার মানুষ। তারা চিৎকার করবে আনন্দে। মানুষকে খুন করার দৃশ্য কী আসলেই আনন্দের হতে পারে?
মেয়েটা বলল, তুমি কী ভাবছ?
কিছু না।
মানুষ কিছু না ভাবতে পারে না। ভাবনাতে কিছু না কিছু থাকতে হয়। তোমার বলা উচিত ছিল আমি কী ভাবছি, সেটা বলতে ইচ্ছে করছে না।
রুহান বলল, আমি কী ভাবছি বলতে ইচ্ছে করছে না।
ঠিক আছে, বলতে হবে না। মেয়েটা রুহানের মুখে কয়েক জায়গায় একটু রং মাখিয়ে আবার তাকে ভালো করে লক্ষ্য করে, তারপর হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। কোনোভাবেই রুহানকে নিষ্ঠুর রক্তলোভী একটা মানুষে পাল্টে দেয়া যাচ্ছে না।
রুহান জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী মেয়ে?
আমার নাম জেনে তুমি কী করবে?
কিছু করব না। এমনি জানতে চাইছি।
আমার নাম ত্রিনা।
ত্রিনা? কী আশ্চর্য!
কেন? আশ্চর্য কেন?
আমার একটি ছোট বোন আছে, তার নাম ত্রিনা। রুহান এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, তোমার কী মনে হয় ত্রিনা, আমি কী কখনো আবার আমার ছোট বোনকে দেখব?
সত্যি কথা বলব?
বলো।
ত্রিনা নামের মেয়েটা বলল, একজন খেলোয়াড়ের ভাই বোন মা এসব থাকতে হয় না। যার আপনজন থাকে সে কখনো খেলোয়াড় হতে পারে না।
রুহান বলল, ও।
ত্রিনা বলল, হ্যাঁ। এখন তুমি কথা বল না, তুমি কথা বললে আমি তোমার মুখে ঠিক করে রং লাগাতে পারি না।