রুহান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, আমি বর্ণমালার কথা শুনেছি। আমাদের গ্রামে একজন বুড়ো মানুষ ছিল, কুরু। সে আমাকে বলেছিল।
কিহি বলল, যদি সত্যি সত্যি ক্রিস্টাল রিডার পৃথিবী থেকে উঠে যায় তাহলে আমাদের এক ধাপ পিছিয়ে যেতে হবে। আমাদের আবার বর্ণমালা শিখতে হবে। আমাদের আবার পড়তে শিখতে হবে, লিখতে শিখতে হবে।
রুহান কিহির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি লিখতে পড়তে জানো?
হ্যাঁ। আমি একটু একটু শিখেছি। আমি বুড়ো মানুষ, আমার অনেক অবসর। আমি আমার অবসরে এ ধরনের অর্থহীন কাজ করি।
রুহান হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, তুমি আমাকে লিখতে পড়তে শেখাবে কিহি।
কেন শেখাব না! অবশ্যই শেখাব। বর্ণমালাগুলো তোমার ক্রিস্টাল রিডারে ঢুকিয়ে নাও, দেখবে দেখতে দেখতে শিখে যাবে।
আমি কোথায় বর্ণমালাগুলো পাব?
আমার কাছে আছে। আমি তোমাকে দেব।
ধন্যবাদ কিহি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
কিহি তার আরামদায়ক চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, পৃথিবীর পুরো জ্ঞানভাণ্ডারই এরকম বর্ণমালা দিয়ে লেখা আছে।
রুহান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, আমিও এটা শুনেছি।
আরো প্রাচীন কালে সেগুলো রাখা হতো কাগজে লিখে, সেগুলোর নাম ছিল বই।
বই?
হ্যাঁ। এখনো পৃথিবীর অনেক জায়গায় বড় বড় লাইব্রেরীতে বই সাজানো আছে। কেউ আর সেগুলো পড়তে পারে না। কিন্তু তবু সাজিয়ে রাখা আছে। কিহি হঠাৎ ঘুরে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কখনো বই দেখেছ?
না।
আমার কাছে একটা বই আছে। তুমি দেখতে চাও?
হ্যাঁ। দেখতে চাই। রুহান উত্তেজিত হয়ে বলল, দেখাবে আমাকে?
কিহি হেসে বলল, কেন দেখাব না? অবশ্যই দেখাব। এসো আমার সাথে।
রুহান কিহির পিছনে পিছনে লম্বা করিডোর ধরে হেঁটে তার ছোট ঘরটিতে হাজির হলো। একটা শক্ত বিছানার পাশে একটা টেবিল, সেখানে কিছু দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্র। সেখান থেকে চতুষ্কোণ একটা জিনিস হাতে তুলে নিয়ে কিহি রুহানের হাতে দিল। রুহান সেটা হাতে নিয়ে খুলে, ভেতরে সারি সারি সাদা পৃষ্ঠা, সেই পৃষ্ঠাগুলোতে বিচিত্র নক্সার মতো চিহ্ন সাজানো। এগুলো নিশ্চয়ই বর্ণমালা দিয়ে লেখা। রুহান কিছুক্ষণ বিস্ময় নিয়ে বইটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর সেটি কিহির হাতে দিয়ে বলল, তুমি এটা পড়তে পারবে?
কিহি হেসে বলল, হ্যাঁ। পারব।
আমাকে একটু পড়ে শোনাও না।
কিহি বইটি তার চোখের সামনে খুলে ধরে বলল, এটা একটা কবিতার বই। কোনো একজন প্রাচীন কবির লেখা কবিতা। এই যে দেখ, এখানে লেখা–
ধান কাটা হয়ে গেছে কবে যেন খেতে মাঠে পড়ে আছে খড়
পাতা কুটো ভাঙা ডিম–সাপের খোলস নীড় শীত
এইসব উত্রায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর
ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ–কেমন নিবিড়।
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কী সুন্দর কথাগুলো।
কিহি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। কথাগুলো খুব সুন্দর। যখন শুরু করেই দিয়েছি, তাহলে তোমাকে বর্ণমালার কয়েকটা অক্ষর দেখিয়ে দিই।
রুহান বলল, হ্যাঁ, দেখাও। সে বইয়ের একটা পৃষ্ঠা খুলে তার উপর ঝুঁকে পড়ল।
সারাটি দিন রুহানকে অস্ত্রের ব্যবহার আর শারীরিক দক্ষতার উপর ট্রেনিং দেয়া হয়। ক্লান্ত ঘর্মাক্ত হয়ে ফিরে এসে সে গোসল করে খেয়ে বর্ণমালাগুলো নিয়ে বসে। দেখতে দেখতে সে পড়তে শিখে গেল। তার এখনো বিশ্বাস হয় না পৃথিবীর সব মানুষ একসময় পড়তে পারত। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যে ক্রিস্টাল রিডারে অভ্যস্ত বলে তার কাছে বর্ণমালা ব্যবহার করে পড়ার এই পুরো প্রক্রিয়াটাকে মনে হচ্ছে আদিম একটা পদ্ধতি। কিন্তু সত্যি সত্যি যদি পৃথিবী থেকে একদিন ক্রিস্টাল রিডার উঠে যায় তখন তো জ্ঞান-বিজ্ঞানকে ধরে রাখার জন্যে এই বর্ণমালার কাছেই ফিরে আসতে হবে। প্রথম প্রথম পড়তে এবং পড়ে কিছু একটা বুঝতে তার যেরকম কষ্ট হতো এখন আর সেটা হয় না। কিহির কাছ থেকে যে কবিতার বইটি এনেছে সেটা সে পড়তে পারে, পড়ে বুঝতে পারে শুধু যে বুঝতে পারে তা নয়, অনুভবও করতে পারে।
দেখতে দেখতে রুহানের জীবনটি মোটামুটি একটা ছকের ভেতর চলে। এলো। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠার পরই তাকে বেশ কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করতে হয়। তারপর তাকে কিছু একটা খেতে হয়–স্বাস্থ্যকর এবং বলকারক খাবার। তারপর তাকে কিছুক্ষণ খেলোয়াড়দের নানা ধরনের খেলার ভিডিও দেখতে হয়, সেটা তার জন্যে নানাভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। কোন খেলোয়াড়ের কী বিশেষত্ব সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে বোঝানো হয়। কে কোন খেলায় কেন জিতেছে সেটা ব্যাখ্যা করা হয়। দেখতে দেখতে রুহান এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করে। তার মাঝে মাঝে মনে হয় সে যদি একজন খেলোয়াড় না হয়ে একজন সক্রেটিস হয়ে যেত তাহলেই কী ভালো হতো? মানুষকে কত সহজে কত দ্রুত খুন করা যায় এই বিদ্যাটা তাহলে অন্তত তাকে নিশ্চয়ই হয়তো শিখতে হতো না।
খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর রুহানকে অস্ত্র হাতে ট্রেনিং শুরু করতে হয়। শরীরের নানা জায়গায় অস্ত্রগুলো বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। সেগুলো তাকে চোখের পলকে টেনে বের করে গুলি করতে হয়। নানা ধরনের টার্গেট থাকে সেখানে লক্ষ্যভেদ করতে হয়। রুহান নিজেই বুঝতে পারে, সে সাধারণ একজন মানুষ থেকে দেখতে দেখতে বিচিত্র বোধশক্তিহীন একজন পেশাদার হত্যাকারীতে পাল্টে যাচ্ছে। মানুষকে কত দ্রুত কোথায় আঘাত করতে হবে সেটি বুঝি তার থেকে ভালো করে আর কেউ জানে না। সে কী এটাই চেয়েছিল?