সারাদিন প্রশিক্ষণ নিয়ে রুহান সন্ধ্যেবেলা পরিশ্রান্ত ঘর্মাক্ত আর ক্লান্ত হয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো। কিছুক্ষণ নিজের বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে তারপর বাথরুমে টগবগে গরম পানিতে রগড়ে রগড়ে গোছল করে বের হয়ে আসে। টেবিলে তার খাবার ঢাকা দেয়া ছিল, রুহান ঢাকনা খুলে খেতে বসে। ফলের রস, যবের রুটি, ভেড়ার মাংসের স্টু, গরম স্যুপ আর কাচা সবজি। বহুদিন সে একরম খাবার খাওয়া দূরে থাকুক চোখেই দেখে নি। খেতে বসে তার হঠাৎ করে মায়ের কথা মনে পড়ল, তার ছোট দুটি বোনের কথা মনে পড়ল। খাবার টেবিলে শুকনো রুটি আর পাতলা পানির মতো স্যুপ খেতে গিয়ে ছোট বোন দুটি কী আপত্তিই না করত। ক্ষুধার্ত রুহানের হঠাৎ করে খিদেটা যেন উবে যায়। সে দীর্ঘসময় খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর খানিকটা রুটি আর এক বাটি স্যুপ খেয়ে উঠে যায়।
রুহান তার নিজের ঘর থেকে বের হয়ে হলঘরের দিকে এগিয়ে যায়, তার খুব সৌভাগ্য যে তাকে ছোট একটা ঘরের ভেতর তালাবদ্ধ করে রাখে নি। তাকে তার ঘর থেকে বের হতে দিয়েছে অন্যদের সাথে মেলামেশা করতে দিয়েছে। মাথায় ইলেকট্রড বসানো ছেলে-মেয়েগুলোর সাথে কথাবার্তা বলার খুব একটা সুযোগ নেই, কিন্তু বৃদ্ধ কিহি খুব চমৎকার একজন সঙ্গী। রুহান বড় হলঘরে গিয়ে কিহিকে খুঁজে বের করল। সে একটা নরম চেয়ারে গা ড়ুবিয়ে বসে। আছে, চোখের দৃষ্টি বহুদূরে। রুহানকে দেখে কিহি সোজা হয়ে বসে বলল, কী খবর রুহান। খেলোয়াড় হবার প্রথম দিনটি তোমার কেমন গেছে?
রুহান কিহির পাশে বসে বলল, আমি ঠিক যেরকম ভেবেছিলাম, সেরকম।
তুমি কী রকম ভেবেছিলে?
অর্থহীন শারীরিক ব্যাপার। সহজাত ব্যাপার। রুহান একটু থেমে কিহির কে তাকিয়ে বলল, তুমি বলতে পারবে কিহি, পৃথিবীটা এরকম কেন হয়ে গেল? পৃথিবীর মানুষ কী এর চাইতে ভালো একটা পৃথিবী পেতে পারে না?
অবশ্যই পারে। কিহি রুহানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, এবং তুমি নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ পৃথিবীর মানুষ সেই পৃথিবী পাবে।
কখন পাবে? কীভাবে পাবে?
সেটা আমি জানি না। কিহি মাথা নেড়ে বলল, আমি ইতিহাস ঘেটে ..দখেছি মানুষের সভ্যতা মাঝে মাঝেই এরকম অন্ধ কানাগলিতে ঘুরপাক খায় 1•• শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে বের হয়ে আসে।
কীভাবে বের হয়ে আসে?
কিহি দুর্বলভাবে হেসে বলল, সেটাও আমি জানি না। মানুষের একেবারে ভেতরে মনে হয় মনুষ্যত্ব বলে একটা জিনিস থাকে। যত দুঃসময়ই হোক সেই মনুষত্ব বুকের ভিতরে ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকে। যখন সবকিছু অন্ধকারে ঢেকে যায় তখন সেই মনুষ্যত্বের ছোট আগুনটা হঠাৎ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে।
রুহান কিহির দিকে তাকিয়ে রইল। এই বৃদ্ধ মানুষটি কথা বলে খুব সুন্দর করে। তার কথা রুহানের খুব বিশ্বাস করার ইচ্ছে করে, কিন্তু সে যেটা বলছে সেটা কী আসলেই সত্যি?
রুহান কিহির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বলছ এক সময় আবার মানুষের সভ্যতা মাথা তুলে দাঁড়াবে?
হ্যাঁ। মাথা তুলে দাঁড়াবে।
রুহান নিজেকে দেখিয়ে বলল, এই যে, আমাকে দেখ।
কিহি হাসিমুখে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখছি।
তোমার কী মনে হয় আমি একজন রক্তপিপাসু খুনি?
না। মোটেও মনে হয় না রুহান। তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি একজন খুব হৃদয়বান তরুণ।
কিন্তু আমাকে কেমন করে মানুষ খুন করতে হয় তার ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। কত দ্রুত কতগুলো অস্ত্র দিয়ে আমি কতগুলো মানুষকে খুন করতে পারি সেটাই হবে আমার কাজ। আর আমি যদি সেটা না করি, তাহলে কী হবে জান?
কিহি বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বলল, জানি।
তাহলে আমাকে অন্যেরা মেরে ফেলবে। এখন তুমিই বল কিহি, আমি কী বেঁচে থাকব না মরে যাব?।
কিহি তার হাত দিয়ে রুহানের হাত স্পর্শ করে বলল, তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে রুহান। মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
একজন খুনির কী মানুষের মর্যাদা আছে?
কিহি মাথা নেড়ে বলল, না। নেই।
তাহলে?
কিহি বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বলল, আমি তোমার এই প্রশ্নের উত্তর জানি রুহান।
রুহান আর কিহি দুজন চুপচাপ বসে থাকে। সামনে অপ্রকৃতস্থ তরুণ তরুণীরা তাদের শিশুর মতো ভঙ্গিতে নিজেদের সাথে কথা বলছে, তর্ক করছে, কেউ কেউ ঝগড়া করছে। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে তাদের দেখতে দেখতে রুহান একসময় বলল, কিহি, তুমি বিশ্বাস করো একসময় মানুষ আবার তাদের সভ্যতা ফিরে পাবে।
হ্যাঁ। আমি বিশ্বাস করি।
সভ্যতার জন্যে দরকার জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা ও গবেষণা।
হ্যাঁ।
রুহান তার গলায় ঝোলানো ক্রিস্টাল রিডারটা দেখিয়ে বলল, তার জন্যে দরকার আমাদের ক্রিস্টাল রিডার। যেটা আমার জন্যে তথ্য বাঁচিয়ে রাখবে, তথ্য দেয়া-নেয়া করবে।
হ্যাঁ। কিহি আবার মাথা নাড়ল।
কিন্তু আমি শুনেছি গত পঞ্চাশ বছরে পৃথিবীতে একটা ক্রিস্টাল রিডার তৈরি হয়নি। তাহলে আমরা নতুন কিছু শিখব কেমন করে?
কিহির মুখে সূক্ষ্ম এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে। সে রুহানের হাতটা নিজের কাছে টেনে এনে যেখানে কিছু বিদঘুটে চিহ্ন এঁকে দেয়া হয়েছে সেটা দেখিয়ে বলল, এটা কী তুমি জান?
না। এটা কী?
এখানে একটা সংখ্যা লেখা আছে।
রুহান অবাক হয়ে বলল, সংখ্যা লেখা আছে?
হ্যাঁ। আমি যদি ভুল না করে থাকি তাহলে সংখ্যাটি হচ্ছে ছয় শূন্য তিন তিন নয় চার দুই।
রুহান অবাক হয়ে বলল, তুমি এটা কেমন করে বললে?
আমি এটা পড়েছি। যখন ক্রিস্টাল রিডার ছিল না তখন মানুষ লিখত এবং সেই লেখা পড়ত। প্রত্যেক কথা লেখা হতো বর্ণমালা দিয়ে। ক্রিস্টাল রিডার আসার পর ভাষার এই লিখিত রূপটা উঠে গেছে। এখন আমরা সরাসরি ক্রিস্টাল রিডারে বলি, ক্রিস্টাল রিডার থেকে শুনি। সেটাতে সবকিছু বাঁচিয়ে রাখি।