খুব ধীরে ধীরে একসময় ক্ৰানার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। গভীর এক ধরনের ঘুমে সে অচেতন হয়ে পড়ে।
ঘরের এক কোনায় প্যানেলের সামনে বসে থাকা ছোট করে ছাটা চুলের মহিলাটি মুখে এক ধরনের সন্তুষ্টির শব্দ করে বলল, চমৎকার! আরো একটা সক্রেটিস রেডি।
মধ্যবয়স্ক মানুষটা বলল, কোনো ঝামেলা ছাড়া শেষ হলো।
মহিলাটি বলল, হ্যাঁ, এর জন্যে আমাদের বুড়োকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। সে কত কী আজগুবি কথা বলে আর আমাদের বেকুব সক্রেটিসরা তার সব কথা বিশ্বাস করে বসে থাকে।
কিহি বলল, এগুলো আজগুবি কথা না। আমি যেটা বলি সেটা বিশ্বাস করেই বলি। এটা এক ধরনের সম্মোহন।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। মহিলাটি হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দিয়ে বলল, আমাদের সক্রেটিসরা যদি শান্তিতে থাকে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। স্টিমুলেশন দেয়ার সময় ঠিক ঠিক তথ্যগুলো দিতে পারলেই হলো।
পাহাড়ের মতো বড় বড় মানুষগুলো এবার উঠে আসে। ক্রানার অবচেতন দেহটা একটা স্ট্রেচারে শুইয়ে দিয়ে তারা ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, কিহি ঘুমন্ত ক্রানার মুখমণ্ডল আলতোভাবে স্পর্শ করে ফিসফিস করে বলল, বিদায় ক্ৰানা। সোনামণি আমার।
ক্রানাকে নিয়ে বের হয়ে যাবার পর বৃদ্ধ কিহিকে কেমন যেন অসহায় দেখায়। দেখে মনে হয় কেউ বুঝি তার ভেতর থেকে কিছু একটা উপড়ে নিয়ে চলে গেছে।
রুহান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। তার বুকের ভেতর বিষণ্ণতাটুকু আরো গভীরভাবে চেপে বসেছে।
০৬. এই অস্ত্রটার নাম মেগাট্রন
এই অস্ত্রটার নাম মেগাট্রন। কমবয়সী মানুষটা ভারী অস্ত্রটা হাত বদল করে বলল, কে এর নাম মেগাট্রন রেখেছে জানি না, কিন্তু খুব স্বার্থক নামকরণ। এটি আসলেই একটা মেগা অস্ত্র। প্রতি সেকেন্ডে দশটা গুলি করতে পারে, লেজার লক অটোমেটিক। অত্যন্ত চমৎকার অস্ত্র–শুধু একটা সমস্যা। অস্ত্রটা ভারী। সব মানুষ সহজে এটা নাড়াচাড়া করতে পারে না।
রুহান এক দৃষ্টে কমবয়সী মানুষটার দিকে তাকিয়ে থেকে কথাগুলো শুনছে, কিন্তু ঠিক মনোযোগ দিতে পারছে না। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে একজন অস্ত্র বিশেষজ্ঞ তাকে অস্ত্রের উপর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
অস্ত্র বিশেষজ্ঞ মানুষটি বিশাল মেগাট্রনটি টেবিলের উপর রেখে তুলনামূলকভাবে ছোট একটা অস্ত্র হাতে নিয়ে বলল, এটার নাম ক্রিকি। ক্রিকি প্রায় মেগাট্রনের মতোই তবে এর গুলির ভর একটু কম। অস্ত্রটা ক্রোমিয়াম এলয় দিয়ে তৈরি, তাই এর ওজন হালকা। অপরাধজগতে খুব জনপ্রিয়। গত খেলায় খেলোয়াড়দের কেউ কেউ এটা ব্যবহার করেছে। মানুষটা অস্ত্রটা টেবিলে রেখে এবারে তৃতীয় একটা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। কুচকুচে কালো এবং হালকা, গুলির লম্বা ম্যাগাজিন বাঁকা হয়ে বের হয়েছে। অস্ত্র বিশেষজ্ঞ মানুষটা মুখে সন্তুষ্টির একটা শব্দ করে বলল, তবে এটা হচ্ছে খেলোয়াড়দের সবচেয়ে প্রিয় অস্ত্র। ব্ল্যাক মার্কেটে এর দাম এখন তেতাল্লিশ হাজার ইউনিট। এত হালকা যে হাতে নিলে মনে হয় বুঝি খেলনা, কিন্তু এটা খেলনা নয়, এটা একেবারে খাঁটি অস্ত্র। প্রতি সেকেন্ডে গুলি করে পাঁচটা—তবে সেই পাঁচটার ট্রাজেক্টরী নিখুঁত। খেলোয়াড়রা তো যুদ্ধ করে না যে তাদের প্রতি সেকেন্ডে দশটা গুলি দরকার—খেলোয়াড়রা হিসেব করে গুলি করে। এর আগের টুর্নামেন্টের শেষ খেলায় মাত্র একটা গুলি খরচ হয়েছিল। বিশ্বাস হয়?
রুহান এক ধরনের ক্লান্তি নিয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে। পৃথিবীতে এত ধরনের অস্ত্র আছে কে জানত। শুধুমাত্র মানুষকে হত্যা করার জন্যে মানুষেরাই এই অস্ত্রগুলো আবিষ্কার করেছে রুহানের সেটা বিশ্বাস হতে চায় না।
কম বয়সী অস্ত্র বিশেষজ্ঞ রুহানের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কোনটা নিতে চাও?
রুহান বলল, আমি কোনোটাই নিতে চাই না।
রুহান খুব একটা মজার কথা বলেছে এরকম ভান করে কম বয়সী অস্ত্র বিশেষজ্ঞ হা হা করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, একজন খেলোয়াড় খালি হাতে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে দৃশ্যটা কল্পনা করতেও কষ্ট।
খেলোয়াড়ের হাতে অস্ত্র থাকতেই হবে?
হ্যাঁ। খেলাটি হচ্ছে তোমার প্রতিপক্ষকে হত্যা করা। তুমি যদি হত্যাই করতে না পার তাহলে কে তোমার খেলা দেখবে?
রুহান বিষণ্ণ দৃষ্টিতে অস্ত্রগুলোর দিকে তাকায়। একটা একটা করে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, নেড়েচেড়ে দেখে। অস্ত্র বিশেষজ্ঞ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে তার অঙ্গভঙ্গি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে।
শেষ পর্যন্ত রুহানকে তার শরীরের কাঠামোর সাথে মিলে যায় এরকম কয়েকটা অস্ত্র বেছে দেয়া হলো। একজন খেলোয়াড় যতগুলি খুশি অস্ত্র নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু যেহেতু পুরো খেলাটিই হচ্ছে এক ধরনের ক্ষীপ্রতার খেলা তাই কেউ বেশি অস্ত্র নিয়ে যায় না, দুটি কিংবা খুব বেশি হলে তিনটি ভিন্ন ধরনের অস্ত্র নিয়ে যায়। অস্ত্রগুলো কোমর থেকে ঝুলিয়ে দেয়া হয় কিংবা উরুতে
বেঁধে নেয়া হয়। কেউ কেউ একটা পিঠে ঝুলিয়ে রাখতে পছন্দ করে। গুলির বাড়তি ম্যাগাজিনগুলো বেল্টের মতো করে বুকে কিংবা পায়ের সাথে বেঁধে নেয়া হয়। প্রথম দিন রুহানকে তার অস্ত্রগুলোর সাথে পরিচিত করানো হলো। দূরে টার্গেট তাকে দিয়ে লক্ষ্যভেদ করানো হলো। যে মানুষ জীবনে কখনো অস্ত্র হাতে স্পর্শ করে নি সেই হিসেবে তার নিশানা অসাধারণ। রুহানের ভেতরে এক ধরনের সহজাত ক্ষীপ্রতা আছে যেটা সচরাচর মানুষের ভেতর চোখে পড়ে না। রুহান নিজেও সেটা জানত না।