ক্রানা শান্ত দৃষ্টিতে কিহির দিকে তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় বলল, আমার ভালো খারাপ কিছুই লাগছে না। সত্যি কথা বলতে কী আমার কোনোরকম অস্তিত্ব আছে বলেই মনে হচ্ছে না।
রুহান একটু অবাক হয়ে ক্ৰানার দিকে তাকাল, মেয়েটি খানিকক্ষণ আগেই পুরোপুরি অপ্রকৃতস্থ ছিল অথচ এখন একেবারে স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা বলছে। কিহি কানার হাত স্পর্শ করে বলল, তুমি আমাকে চিনতে পারছ ক্ৰানা।
হ্যাঁ। অবশ্যই চিনতে পারছি। তুমি হচ্ছ কিহি। আমাদের সবার প্রিয় কিহি। তোমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি কে? তাকে দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে।
এ হচ্ছে রুহান।
ক্ৰানা ফিসফিস করে বলল, রুহান রুহান!
ঘরের কোনায় যন্ত্রপাতির প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট করে ছাটা চুলের মেয়েটি গলা উঁচিয়ে ডাকল, বুড়ো।
কিহি মনে হয় এই অবহেলার ডাকটিতে অভ্যস্ত, বেশ সহজভাবেই বলল, বলো।
তুমি কিছুক্ষণ মেয়েটার সাথে কথা বলতে পারবে? যেন সে সজাগ থাকে?
পারব।
চমৎকার! আমরা তার অবচেতন মনে কাজ করছি।
ঠিক আছে। বলে কিহি আবার ক্রানার উপর ঝুঁকে পড়ল। বলল, তোমার সব কথা মনে আছে কানা?
ক্ৰানা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। মনে আছে।
তুমি এখন আমাকে চিনতে পারছ ক্ৰানা?
হ্যাঁ। চিনতে পারছি। তুমি কিহি। আমাদের সবার খুব প্রিয় একজন মানুষ তোমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রুহান।
তুমি কী আমার সব কথা বিশ্বাস করবে ক্ৰানা?
করব। নিশ্চয়ই করব।
তাহলে শোন। আমাদের মনে যে দুঃখ-কষ্ট-আনন্দ-বেদনা হয় সেগুলো হচ্ছে মস্তিষ্কের ভেতরের বিশেষ এক ধরনের পরিস্থিতি।
ক্ৰানা নামের মেয়েটার মুখে খুব সূক্ষ্ম এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে, সে বলে, আমি জানি। আমার মস্তিষ্কে এখন এরা কিছু একটা করছে এখন আমি সবকিছু বুঝতে পারি।
কিহি গলা নামিয়ে বলল, হ্যাঁ। এরা তোমার মস্তিষ্কে এক ধরনের স্টিমুলেশন দিচ্ছে। যখন স্টিমুলেশন বন্ধ করে দেবে তখন তুমি আবার আগের মতো হয়ে যাবে। স্টিমুলেশন থাকতে থাকতে আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই যেটা তুমি সবসময় মনে রাখবে।
কী কথা কিহি? আমরা সবাই তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমরা তোমার সব কথা মনে রাখব।
কিহি কানার হাত ধরে নরম গলায় বলল, দুঃখ-কষ্ট-আনন্দ-বেদনাযন্ত্রণা-সুখ সবকিছুই যদি মস্তিষ্কের বিশেষ একটা অবস্থা হয়ে থাকে তাহলে কেন আমরা সেটা নিয়ন্ত্রণ করব না? কেন আমরা আমাদের মস্তিষ্কের পরিস্থিতিকে সবসময় আনন্দ কিংবা সুখের পরিস্থিতি করে রাখব না? তাহলে যখন দুঃখ-কষ্ট আর যন্ত্রণা আসবে সেটাও আমাদের কষ্ট দিতে পারবে না!
ক্ৰানা ফিসফিস করে বলল, সেটা আমরা কেমন করে করব?
কিহি ক্ৰানার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, তুমি মনে করে নাও পৃথিবীতে কোনো অশুভ কিছু নেই। মনে করো সবাই ভালো। মনে মনে কল্পনা করো পৃথিবীটা খুব সুন্দর একটা জায়গা। এখানে শুধু আনন্দ আর সুখ। ক্রানা তুমি মনে মনে কল্পনা করো যে তুমি খুব খু-উব সুখী একজন মানুষ। তারপর তুমি মনের ভেতরে সেই সুখটা ধরে রাখ। পারবে না?
ক্ৰানা ধীরে ধীরে তার চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ সেভাবে থাকে। তার মুখে এক ধরনের অপার্থিব হাসি ফুটে ওঠে, দেখে মনে হতে থাকে তার ভেতরে এক ধরনের অলৌকিক শান্তি এসে ভর করেছে। চোখ দুটো বন্ধ করে সে ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ কিহি। আমি পারছি। আমার ভেতরে এক ধরনের গভীর শান্তি এসেছে। আমার মনে হচ্ছে আমি সবাইকে ক্ষমা করে দিতে পারব। কারো বিরুদ্ধে আমার আর কোনো ক্ষোভ নেই কিহি। আমার ভেতরে আর কোনো আক্রোশ নেই।
ক্রানার হাতে অল্প চাপ দিয়ে কিহি বলল, চমৎকার! এটা তোমার ভেতর ধরে রাখতে পারবে না?
ক্রানা বলল, আমি জানি না। এখন তো আমার মস্তিষ্কের ভেতর স্টিমুলেশন দিচ্ছে তাই কাজটা খুব সহজ। যখন স্টিমুলেশন থাকবে না তখন কী হবে আমি জানি না।
নিজের উপর বিশ্বাস রাখ ক্ৰানা, তুমি পারবে। তোমার কাজটা আরো সহজ করে দিচ্ছি। কিহি তার ডান হাতটা জানার চোখের সামনে ধরে বলল, এই দেখ আমার হাতে একটা ক্রস আঁকা আছে। যখন তুমি মনে মনে সুখ আর আনন্দ আর গভীর এক ধরনের শান্তি অনুভব করছ তখন তুমি এই ক্রসটির দিকে তাকিয়ে থাক। তোমার মস্তিষ্কে তাহলে এর স্মৃতি রয়ে যাবে। ভবিষ্যতে। যখনই তুমি এই ধরনের একটি ক্রস চিহ্ন দেখবে সাথে সাথে তোমার এই গভীর আনন্দ, সুখ আর শান্তির কথা মনে হবে।
কিন্তু আমি কোথায় দেখব এই ক্রস?
দেখবে। অনেক জায়গায় দেখবে। দুটো গাছের ডাল একটার উপর দিয়ে আরেকটা যাবার সময় ক্রস চিহ্ন তৈরি করে। মানুষ কিছু একটা মনে রাখার জন্যে ক্রস চিহ্ন আঁকে। তোমার দুই হাত যখন তোমার কোলের উপর রাখ একটা হাত অন্য হাতের উপর ক্রস তৈরি করে। মানুষ পায়ের উপর পা রেখে বসে। সেটাও ক্রস। তোমার চারপাশে ক্রস, ক্ৰানা। কাজেই তুমি ভুলবে না। কিছুতেই ভুলবে না।
ঠিক আছে।
তুমি তাহলে আমার হাতের চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাক। বুকের ভেতর গভীর আনন্দ, সুখ আর শান্তি অনুভব করতে করতে তাকিয়ে থাক। প্রিয় ক্রানা আমার, সোনামণি, তোমার জন্যে আমাদের সবার গভীর ভালোবাসা। গভীর গভীর ভালোবাসা। .
রুহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে কিহি এবং ক্রানার দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখে মনে হতে থাকে সে বুঝি কোনো একটি অলৌকিক জাদুমন্ত্রের প্রক্রিয়া দেখছে। কী গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে কিহি তার প্রত্যেকটা কথা উচ্চারণ করছে। আর কী সহজেই ক্ৰানা তার প্রত্যেকটা শব্দ বিশ্বাস করছে। ক্রানার মুখে গভীর এক ধরনের প্রশান্তির চিহ্ন, দেখে মনে হয় পৃথিবীর কোনো নীচতা, হীনতা কোন ষড়যন্ত্র, কোনো অন্যায়, কোনো অবিচার তাকে বুঝি আর কোনোদিন স্পর্শ করতে পারবে না।