ঠিক এরকম সময় হলঘরের এক কোনায় দুজন উচ্চস্বরে কথা কাটাকাটি শুরু করে দেয়, অন্যেরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। কিহি এগিয়ে যায়, শান্ত গলায় বলে, কী হলো? তোমরা দুজন আবার কী নিয়ে ঝগড়া শুরু করলে?
যে দুজন চেচামেচি করছিল তারা প্রায় সাথে সাথে কিহির দিকে তাকিয়ে অপরাধীর মতো একটু হাসার চেষ্টা করে চুপ করে গেল। কিহি ঠিকই বলেছে। এই মানুষগুলো অপ্রকৃতস্থ কিন্তু তারপরেও তারা কিহির মমতাটুকু অনুভব করতে পারে।
রুহান বলল, এরা তোমাকে খুব ভালোবাসে।
হ্যাঁ। কিহি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মাথায় যখন ইলেকট্রড বসায় তখন মস্তিষ্কের কোথায় কী ক্ষতি হয় কে জানে কিন্তু এরা একেবারে শিশুর মতো হয়ে যায়।
ঠিক তখন কোথায় জানি ঘটাং করে একটা শব্দ হলো এবং ঘরঘর শব্দ করে কাছাকাছি একটা দেয়াল সরে যেতে শুরু করল। ঘরের ভেতরে অপ্রকৃতস্থ মানুষগুলোর মধ্যে হঠাৎ কেমন যেন একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, সবাই হুঁটোপুটি করে বড় হলঘরটার এক কোনে গিয়ে একজন আরেকজনকে ধরে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকে। দরজার খোলা অংশটা দিয়ে চারজন মানুষ এসে ঢুকল। তাদের গায়ে নীল রঙের জাম্পস্যুট। ছোট করে ছাটা চুলের একজন মহিলার হাতে একটা ছোট ব্যাগ, সেখান থেকে কিছু যন্ত্রপাতি উঁকি দিচ্ছে। একজন মধ্যবয়স্ক ছোটখাটো মানুষ অন্য দুজন বিশাল দেহী।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি কিহির দিকে তাকিয়ে বলল, কী খবর বুড়ো। তোমার জ্ঞানী শিশুরা কেমন আছে?
কিহি কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটা হাসি হাসি মুখে বলল, আমাদের দেখে ইঁদুরের ছানার মতো এক কোনায় কেমন জড়ো হয়েছে দেখেছ?
কিহি এবারেও কোনো কথা বলল না।
যন্ত্রপাতির ব্যাগ হাতে ছোট করে ছাটা চুলের মেয়েটি বলল, স্টিমুলেশন দেবার পর এরাই আবার কেমন গুছিয়ে কথা বলতে থাকে! দেখে বিশ্বাস হয় না।
কিহি জিজ্ঞেস করল, কাউকে নেবে?
হ্যাঁ।
কাকে?
মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ তার ক্রিস্টাল রিডারটা দেখে বলল, ক্রানাকে।
দূরে জড়াজড়ি করে থাকা ছেলে-মেয়েগুলোর মধ্যে একটা মেয়ে হঠাৎ আতঙ্কের একটা শব্দ করে নিজের মুখ-ঢেকে আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করে। রুহান চিনতে পারল, কিছুক্ষণ আগে এই মেয়েটিই তার ঘরে ঢুকে গিয়েছিল।
মেয়েটির আকুল হয়ে কান্না শুনে নীল জাম্পস্যুট পরা মানুষগুলো এক ধরনের কৌতুক অনুভব করে। তারা নিজেরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে হাসতে শুরু করে।
রুহান বলল, এর ভেতরে তোমরা হাসার মতো কী খুঁজে পেলে।
রুহানের কথা শুনে মানুষগুলো কেমন যেন অবাক হয়ে তার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। মধ্যবয়স্ক মানুষটা অবাক হয়ে বলল, তুমি কে?
রুহান বলল, আমি এখানে নিজ থেকে আসি নি। তোমরা আমাকে ধরে এনেছ। তোমরা বলো আমি কে?
মানুষটার মুখ পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। থমথমে গলায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন ছোট করে চুল ছাটা মহিলাটি বলল, এর নাম রুহান। রুহান আমাদের নতুন খেলোয়াড়।
খে-খেলোয়াড়? মধ্যবয়স্ক মানুষটার পাথরের মতো কঠিন মুখটা দেখতে দেখতে কেমন জানি নরম হয়ে যায়। মুখে একধরনের বিস্ময়ের ভাব ফুটে ওঠে, বিগলিত ভঙ্গিতে বলে, তুমি খেলোয়াড়?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি সেটা শুনেছি। এখনো জানি না।
তোমাকে আমাদের সবার পক্ষ থেকে অভিনন্দন। আমাদের এই ট্রেনিং সেন্টার তোমাকে নিশ্চয়ই একেবারে প্রথম শ্রেণীর একটা খেলোয়াড় বানিয়ে দেবে।
মানুষটির কথার সাথে সাথে অন্যেরাও কেমন জানি বিগলিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে থাকে।
রুহান বলল, তোমরা এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি। কোন প্রশ্ন?
রুহান নিচু গলায় বলল, তোমাদের দেখে ও তোমাদের কথা শুনে মেয়েটি ভয় পেয়ে কাঁদছে। এর মধ্যে কোন অংশটুকু হাসির?
মধ্যবয়স্ক মানুষটির মুখে অপমানের একটা সূক্ষ্ম ছাপ পড়ল। সে হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভান করে বলল, তুমি সেটা এখন বুঝবে না। এখানে কিছুদিন থাক তাহলে নিজেই বুঝতে পারবে।
রুহান মাথা নেড়ে বলল, মনে হয় না।
মধ্যবয়স্ক মানুষটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে সামনে এগিয়ে যায়, জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে-মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে ক্রানা কে?।
আকুল হয়ে কাঁদতে থাকা মেয়েটা আরো জোরে ড়ুকরে কেঁদে উঠল। মানুষটা বলল, তুমি?
মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ল।
এসো তাহলে। চলে এসো।
মেয়েটা মাথা নাড়ল, সে আসবে না।
না এলে চলবে না। মধ্যবয়স্ক মানুষটার কণ্ঠস্বর কঠোর হয়ে ওঠে, এসো।
মেয়েটা মাথা নেড়ে বলল, না।
মানুষটা এবার পিছনে তাকাল, বিশাল দেহী দুজন মানুষ এবারে এগিয়ে যায়। ক্রানা নামের মেয়েটিকে দুইজন দুই পাশ থেকে ধরে ফেলে তারপর প্রায় শূন্যে তুলে সরিয়ে নিয়ে আসে। ক্রানা হাত পা ছুড়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে কিন্তু সেই কান্নায় মানুষগুলো এতটুকু বিচলিত হয় না।
মধ্যবয়স্ক মানুষটা কিহির দিকে তাকিয়ে বলল, বুড়ো তুমি আস আমাদের সাথে।
কিহি কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল। রুহান জিজ্ঞেস করল, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটিকে?
সিস্টেম লোড করার জন্যে। ছোট করে চুল ছাটা মহিলাটা বলল, ক্রিভন থেকে একটা অর্ডার এসেছে। ক্রিভন অনেক বড় যুদ্ধবাজ মানুষ। সে একটা যুদ্ধের এক্সপার্ট কিনতে চায়।
রুহান অবাক হয়ে বলল, এই বাচ্চা মেয়েটা যুদ্ধে এক্সপার্ট?
মহিলাটি হেসে বলল, আমরা যখন সিস্টেম ললাড করে দেব সে এক্সপার্ট হয়ে যাবে। এমনিতে কেউ বুঝবে না কিন্তু যখন স্টিমুলেশন দেবে তখন। বুঝবে।