শীর্ণ মেয়েটি দুই হাত পাশে ঝুলিয়ে একটি বিচিত্র ভঙ্গিতে করিডোর ধরে হটতে শুরু করে। রুহান মেয়েটিকে ডাকবে কী না বুঝতে পারে না। তার পিছু পিছু হেঁটে হেঁটে সে একটা হলঘরে হাজির হলো। সেখানে আরো বেশ কয়েকজন মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এক নজর দেখেই রুহান বুঝতে পারে তাদের সবার মস্তিষ্কে ইলেকট্রড প্রবেশ করিয়ে রাখা আছে। তাদের দৃষ্টি হয় অস্বাভাবিক উজ্জ্বল না হয় উদভ্রান্তের মতো। তারা সবাই বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথা বলছে। দুই-একজনের একটি হাত হঠাৎ হঠাৎ নড়ে উঠছে, মনে হয় সেটার উপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পুরো দৃশ্যটি এত অস্বাভাবিক যে রুহান স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
হলঘরের এক কোনা থেকে হঠাৎ একজন তার কাছে এগিয়ে আসে, ব্যস্ত গলায় বলল, এনেছ? এনেছ তুমি?
তার কী আনার কথা সে জানে না, সেটা নিয়ে সে কোনো প্রশ্ন না তুলে বলল, না আনি নি।
না আনলে কেমন করে হবে? উপাদানগুলোর পরিমাপ সমান হতে হবে। বিস্ফোরকের ক্ষমতা নির্ভর করে তার উপাদানগুলোর উপর। অক্সিজেন সমৃদ্ধ উপাদান। তুমি যদি না আনো- মানুষটি নিজের মনে কথা বলতে বলতে অন্যদিকে সরে গেল।
রুহান খুব সাবধানে তার বুকের ভেতর থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দেয়। আর একটু হলে সম্ভবত তারও এখানে এভাবে থাকতে হতো। বুদ্ধিমত্তা। পরীক্ষা করার সময় সে যদি প্রশ্নগুলোর উত্তর ইচ্ছে করে ভুল করে না দিত তাহলে কী তার মস্তিষ্কেও এভাবে ইলেকট্রড বসিয়ে দিত না?
কে যেন তার কাঁধে হালকাভাবে স্পর্শ করে। রুহান মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, একজন বয়স্ক মানুষ, চুল ধবধবে সাদা, মুখে বয়সের বলিরেখা। মানুষটি নরম গলায় বলল, তুমি কে? তোমার মাথায় তো ইলেকট্রড নেই, তুমি এখানে কী করছ?
রুহান বলল, আমার নাম রুহান। আমি জানি না আমি এখানে কী করছি।
বয়স্ক মানুষটি হেসে বলল, আমরা আসলে কেউই জানি না আমরা কী করছি। আমাদের জন্মাটাই একটা বড় রহস্য।
রুহান কথাটি সহজ অর্থেই বলেছিল, বৃদ্ধ মানুষটি অনেক ব্যাপক অর্থে দার্শনিকভাবে গ্রহণ করেছে।
বৃদ্ধ মানুষটি তার হাত বাড়িয়ে বলল, আমার নাম কিহি। আমি সক্রেটিসদের দেখাশোনা করি।
রুহান ভুরু কুঁচকে বলল, কাদের দেখাশোনা করো?
কিহি হাত দিয়ে মস্তিষ্কে ইলেকট্রড বসানো চারপাশের অপ্রকৃতস্থ মানুষগুলোকে দেখিয়ে বলল, এই যে এই ছেলে-মেয়েগুলোকে। এদেরকে এখানে সক্রেটিস বলে।
এরাই তাহলে সেই সক্রেটিস! আমি এদের কথা শুনেছি।
হ্যাঁ। একটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর রসিকতা। সক্রেটিস খুব জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। এই ছেলে-মেয়েগুলোর মস্তিষ্কে যখন এই ইলেকট্রড দিয়ে ইম্পালস দেয়া হয় তখন এরাও কিছুক্ষণের জন্যে জ্ঞানী হয়ে যায়। সে জন্যে এদেরকে বলে সক্রেটিস।
এদের সবাইকে দেখে মনে হয় এরা অপ্রকৃতস্থ।
হ্যাঁ। এরা অপ্রকৃতস্থ। যখন মস্তিষ্কে ইম্পালস দেয়া হয় তখন এরা কিছুক্ষণের জন্যে স্বাভাবিক হয়। তখন তারা কোনো কোনো বিষয়ে অনেক বড় বিশেষজ্ঞ হয়ে যায়। তারা তখন অনেক বড় বড় সমস্যা সমাধান করতে পারে।
কিন্তু এমনিতে এরা অপ্রকৃতস্থ।
হ্যাঁ, এমনিতে এরা অপ্রকৃতস্থ।
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এটি একটি অত্যন্ত বড় ধরনের নিষ্ঠুরতা।
হ্যাঁ। এটি অত্যন্ত বড় একটি নিষ্ঠুরতা।
রুহান কিহির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যদি জান এটি এক ধরনের নিষ্ঠুরতা তাহলে তুমি কেন এ ধরনের কাজ করো? কেন ছেড়েছুড়ে চলে যাও না?
কিহি একটু হাসার চেষ্টা করল কিন্তু সেই হাসিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হলো না। নিচু গলায় বলল, পারলে চলে যেতাম। নিশ্চয় চলে যেতাম। কিন্তু পারছি না।
কেন পারছ না?
যারা আমাকে ধরে এনেছে তারা কী কখনো আমাকে যেতে দেবে?
রুহান ভালো করে কিহির দিকে তাকাল, সে বুঝতে পারে নি এই বৃদ্ধ মানুষটাও তাদের মতো একজন ধরে আনা বন্দী মানুষ। রুহান থতমত খেয়ে বলল, আমি দুঃখিত কিহি। আমি বুঝতে পারি নি। আমি ভেবেছিলাম এখানে বুঝি শুধু কমবয়সী তরুণদের ধরে আনে। আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি ওদের একজন।
কিহি মাথা নেড়ে বলল, না। আমি ওদের একজন নই। হাত দিয়ে চারপাশের অপ্রকৃতস্থ ছেলে-মেয়েগুলোকে দেখিয়ে বলল, আমি এদের একজন। এই দুর্ভাগা ছেলে-মেয়েগুলোর দেখাশোনা করি। এদের মতো অসহায় পৃথিবীতে আর একজনও নেই। যতদিন এখানে থাকে আমি তাদের খানিকটা মমতা দিই, ভালোবাসা দিই। অপ্রকৃতস্থ হলেও তারা ভালোবাসা বুঝে। এখন কী মনে হয় জান?
কী?
আমাকে যদি এখন ছেড়েও দেয়। আমি সম্ভবত ওদের ছেড়ে চলে যেতে পারব না।
রুহান কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কিহি অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ অপ্রকৃতস্থ ছেলে-মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে আবার মাথা ঘুরিয়ে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে যারা আসে তাদের সবার মাথাতেই ইলেকট্রড বসানো থাকে। তুমি অন্যরকম, এখানে তোমাকে কেন এনেছে?
রুহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার মাথায় ইলেকট্রড নেই–মনে হয় সরাসরি বুলেট বসাবে!
কেন? এরকম কথা কেন বলছ?
আমি একজন খেলোয়াড়।
বৃদ্ধ কিহি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ফিসফিস করে বলল, খেলোয়াড়? মানুষকে গুলি করার যে খেলা সেই খেলার খেলোয়াড়?
হ্যাঁ। আমাকে ট্রেনিং দেবার জন্যে এনেছে।
কিহি কিছুক্ষণ রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর নিচু গলায় বলল, আমি জানি না কে বেশি দুর্ভাগা। তুমি নাকি এই সক্রেটিসের সন্তানেরা।