রুহান অবাক হয়ে বলল, খেলোয়াড়? কীসের খেলোয়াড়?
লাল চুলের মহিলাটি বলল, এক সময় পৃথিবীতে কত হাজার রকম বিনোদন ছিল! এখন কিছু নেই। এখন একমাত্র বিনোদন হচ্ছে এই খেলা—
কীসের খেলা?
একজন আরেকজনকে গুলি করার খেলা।
রুহান হতবাক হয়ে সামনে বসে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। সে এখনো পরিষ্কার করে বুঝতে পারছে না তারা কী নিয়ে কথা বলছে। মধ্যবয়স্ক মানুষটি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমরা তোমাকে একেবারে প্রথম শ্রেণীর ট্রেনিং দিব। তোমাকে সব ধরনের অস্ত্র চালানো শেখাব তারপর তোমাকে লক্ষ ইউনিটে বিক্রি করব।।
লাল চুলের মহিলাটি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তোমার উপর বাজি ধরা হবে।
বাজি?
হ্যাঁ। আমরা আশা করছি দেখতে দেখতে তোমার রেটিং উপরে উঠে যাবে। আমাদের নাম তখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।
রুহান খানিকটা বিস্ময় নিয়ে তার সামনে বসে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, এখানে তোমাকে ট্রেনিং দেয়া যাবে না। ট্রেনিংয়ের জন্যে তোমাকে আমাদের কেন্দ্রীয় অফিসে পাঠাতে হবে।
সেটা কোথায়?
লাল চুলের মহিলাটি বলল, এখান থেকে শ খানেক কিলোমিটার দূরে। পাহাড়ের উপর। চমত্তার জায়গা।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, হ্যাঁ চমৎকার জায়গা, পাহাড়ের উপর চমৎকার একটি হৃদ। সেই হৃদের পাশে অফিস।
সেখানে আজেবাজে মানুষের ভিড় নেই।
খাওয়া খুব ভালো। সব খাঁটি প্রাকৃতিক খাবার। মধ্যবয়স্ক মানুষটি জিব দিয়ে তার ঠোঁট চেটে বলল, তুমি যদি চাও তোমাকে সঙ্গিনী দেয়া হবে। চমৎকার সব মেয়ে আছে হেড অফিসে।
রুহান কোনো কথা না বলে মানুষগুলোর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। লাল চুলের মহিলাটি বলল, তোমার কী কোনো প্রশ্ন আছে ছেলে?
আমার নাম রুহান।
ও, আচ্ছা। হ্যাঁ। রুহান–তোমার কী কোনো প্রশ্ন আছে রুহান?
হ্যাঁ। আমার একটা প্রশ্ন আছে।
কী প্রশ্ন?
আমি যদি তোমাদের প্রস্তাবে রাজি না হই? আমি যদি মানুষকে গুলি করে মারার এই খেলা খেলতে না চাই?
সামনে বসে থাকা মানুষগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। মধ্যবয়স্ক মানুষটির মুখে একটু কৌতুকের হাসি ফুটে ওঠে এবং সে হঠাৎ শব্দ করে হেসে ওঠে।
রুহান বলল, কী হলো? তুমি হাসছ কেন?
মানুষটি হাসি থামিয়ে বলল, তোমার কথা শুনে। তোমার আগে কেউ কখনো এই প্রশ্ন করে নি।
ঠিক আছে। কিন্তু আমি এই প্রশ্ন করছি।
ঠিক আছে ছেলে–
আমার নাম রুহান।
ঠিক আছে রুহান, আমি তোমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিই। মধ্যবয়স্ক মানুষটা আবার জিব দিয়ে তার ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে বলল, পৃথিবীটা এখন আগের মতো নেই রুহান। মানুষ এখন নিজের ইচ্ছে মতো কিছু করতে পারে না। এখন মানুষ হয় আদেশ দেয় না হয় আদেশ শোনে। তোমার এখন আদেশ শোনার কথা। তুমি যদি আমাদের আদেশ না শোনো তাহলে তোমাকে আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই।
লাল চুলের মহিলাটি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, তোমাকে এখন আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু তোমার মস্তিষ্কটা আমরা ব্যবহার করতে পারব না, কিংবা তোমার হৃৎপিণ্ডটা কারো কাছে বিক্রি করতে পারব না সে কথাটা তো কেউ বলে দেয় নি। বুঝেছ?
রুহান একটু মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি।
চমৎকার! মধ্যবয়স্ক মানুষটা বলল, তুমি তাহলে প্রস্তুত হয়ে যাও। তোমাকে আমরা এখনই আমাদের কেন্দ্রীয় অফিসে পাঠাব।
সামনে বসে থাকা চারজন মানুষ উঠে দাঁড়ায় এবং রুহান হঠাৎ নিজের ভেতরে এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করে। গভীর এক ধরনের ক্লান্তি।
০৫. রুহান তার ঘরের জানলা দিয়ে
রুহান তার ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। সামনে বিশাল একটি হদ, সেইদকে ঘিরে গাঢ় সবুজ রঙের বনভূমি। দূরে পর্বতমালা, ধীরে ধীরে তার রং হালকা হয়ে মিলিয়ে গেছে। অপূর্ব এই প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিকে রুহান বুভুক্ষের মতো তাকিয়ে থাকে। স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানলাটি তাকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে সে আসলে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী। বাইরের এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য কোয়ার্টজের জানলা দিয়ে দেখতে পাবে কিন্তু কখনোই তার অংশ হতে পারবে না। স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানলা দিয়ে তাকে এই প্রকৃতি থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে।
রুহান একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলল এবং ঠিক তখন তার ঘরের ভেতর খুট করে একটা শব্দ হলো। রুহান মাথা ঘুরিয়ে তাকায় এবং দেখতে পায় তার ঘরের দরজা খুলে একজন কমবয়সী মেয়ে ভেতরে ঢুকছে। তার মুখটি শীর্ণ এবং চোখের নিচে কালি। মেয়েটির চুল উষ্কখুষ্ক এবং চোখ দুটি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল, প্রায় অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো। রুহান একটু অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। শীর্ণ মেয়েটি কোনো কথা না বলে জ্বলজ্বলে চোখে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল।
রুহান একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, তুমি কি আমার কাছে এসেছ?
মেয়েটি রুহানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ওমেগা ফাংশনের তৃতীয় সংখ্যাটি কত জান?
মেয়েটি কী বলছে রুহান তার কিছুই বুঝতে পারল না, মাথা নেড়ে বলল, না জানি না।
আমার ধারণা কমপ্লেক্স তলে তার কোনো রুট নেই। তোমার কী ধারণা?
আমি বলতে পারব না।
নেই। নিশ্চয় নেই। ওমেগা ফাংশনের সহগের উপর সেটা নির্ভর করার কথা। শীর্ণ মেয়েটি বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে বলতে ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে যেতে শুরু করে এবং তখন রুহান হঠাৎ করে শিউরে ওঠে। মেয়েটার মাথার পেছন থেকে একটা ধাতব ইলেকট্রড বের হয়ে আসছে। তার মস্তিষ্কের ভেতর সেটা প্রবেশ করানো রয়েছে।