ভাবলেশহীন চেহারার মানুষটি রুহানকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, যাও।
রুহান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে দেয়ালের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো। একটা পাথর থেকে অন্য পাথরের আড়ালে ছুটে না গিয়ে সে সোজা গ্রুজানের দিকে হেঁটে যেতে থাকে।
পেছন থেকে কে যেন চিৎকার করে ওঠে, এই ছেলে তুমি কোথায় যাচ্ছ?
রুহান সেই কথায় কান দিল না।
গ্রুজান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অবাক হয়ে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হলো কিছু একটা বলবে কিন্তু কিছু বলল না। রুহান তার কাছাকাছি গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল। জানের মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে, খসখসে গলায় বলল, তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
রুহান কোনো কথা না বলে স্থির চোখে জানের দিকে তাকিয়ে রইল। গ্রুজান মুখ বিকৃত করে বলল, নর্দমার পোকা! তুমি যখন ছুটে যাবে তখন তোমাকে আমি পাখির মতো গুলি করে মারতে পারি। সামনাসামনি মারার আমার কোনো ইচ্ছে নেই। যাও। ভাগো–পালাও।
রুহান এবারেও কোনো কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে জানের দিকে তাকিয়ে রইল। গ্রুজান ধমক দিয়ে বলল, আহাম্মকের বাচ্চা! কী হলো তোমার?
কিছু হয় নি।
তাহলে?
রুহান ফিসফিস করে বলল, তোমার আর আমার মধ্যে কে বেঁচে থাকবে সেটা নির্ভর করছে–কে আগে তার অস্ত্রটি তুলতে পারে।
গ্রুজান হতচকিতের মতো রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, তু-তু-তুমি?
হ্যাঁ।
আহাম্মকের বাচ্চা! তুমি ভাবছ তুমি আমাকে গুলি করবে?
আমি কিছু ভাবছি না। আমি তোমার দিকে তাকিয়ে আছি। যেই মুহূর্তে তুমি অস্ত্রটা তোলার চেষ্টা করবে, আমি তখন তোমাকে গুলি করব।
জান হতবাক হয়ে রুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তু-তুমি?
হ্যাঁ। আমি প্রস্তুত।
গ্রুজান রুহানের চোখের দিকে তাকাল। গ্রুজানের চোখে প্রথমে ছিল তাচ্ছিল্য, রুহানের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেই দৃষ্টিতে প্রথম বিস্ময় তারপর খুব ধীরে ধীরে বিস্ময়কর এক ধরনের আতঙ্ক এসে ভর করে। রুহান দেখতে পায় গ্রুজানের সমস্ত শরীর ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে আসছে, দেখতে পায় তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠছে। গ্রুজান প্রথমে বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিল তারপর ঠিক যেই মুহূর্তে অস্ত্রটি তোলার চেষ্টা করে রুহান সাথে সাথে তাকে গুলি করল।
রুজানের দেহটি গড়িয়ে তার পায়ের কাছে এসে পড়ল। রুহান স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। চারপাশে মানুষের চিকার, হইচই, চেচামেচি এবং পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। রুহান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে, কিছুতেই তার কিছু আসে যায় না। সে কখনোই ভাবে নি যে সে কখনো কোনো মানুষকে খুন করবে, কিন্তু কী আশ্চর্য সে সত্যি সত্যি একটা মানুষকে খুন করেছে। সত্যিই কী যাকে খুন করেছে সে মানুষ?
মধ্যবয়স্ক মানুষটি চতুর্থবারের মতো রুহানকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেমন করে জানকে হত্যা করেছ?
রুহান চতুর্থবারের মতো উত্তর দিল, আমি জানি না।
মধ্যবয়স্ক মানুষটির পাশে বসে থাকা লাল চুলের মহিলাটি বলল, তুমি জান না বললে তো হবে না। সবাই দেখেছে তুমি তাকে গুলি করে মেরেছ।
রুহান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমি আসলে হত্যা, খুন এসব কখনো দেখি নি। যখন দেখলাম ছেলেটাকে গ্রুজান মেরে ফেলল–
না না না। লাল চুলের মহিলাটি মাথা নেড়ে বলল, তুমি কেন মেরেছ সেটা জিজ্ঞেস করি নি। জিজ্ঞেস করেছি কেমন করে মেরেছ।
রুহান একটু অবাক হয়ে বলল, আমাকে যে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা দিয়েছিল —
আমরা সেটা জানি! লাল চুলের মহিলাটি একটু অধৈর্য হয়ে বলল, আমরা জানতে চাইছি গ্রুজানের মতো এত বড় একজন যোদ্ধাকে তুমি কেমন করে হত্যা করলে?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, তুমি অস্ত্র ব্যবহার করা কোথায় শিখেছ?
আমি কোথাও শিখি নি। এটা ছিল আমার প্রথম অস্ত্র ব্যবহার।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, অসম্ভব!
না। অসম্ভব না। রুহান মাথা নেড়ে বলল, সত্যিই আমি এর আগে কখনো অস্ত্র হাতে নেই নি।
রুহানের সামনে বসে থাকা চারজন মানুষ কেমন যেন হতচকিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা দুজন নিজেদের ভেতরে নিচু গলায় একটু কথা বলল। তারপর রুহানের দিকে তাকাল, একজন বলল, তোমাকে অভিনন্দন ছেলে।
রুহান অবাক হয়ে বলল, অভিনন্দন?
হ্যাঁ।
আমি তোমাদের একজনকে মেরে ফেলেছি সে জন্যে তোমরা আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছ?
হ্যাঁ। তুমি যেভাবে গ্রুজানকে মেরেছ তার তুলনা নেই। মানুষটি জিব দিয়ে পরিতৃপ্ত ভঙ্গির একটা শব্দ করে বলল, তোমার মতো এরকম তড়িৎগতির মানুষ আমরা আগে কখনো দেখি নাই।
রুহান এখনো মানুষটির কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না, ইতস্তত করে বলল, কিন্তু তোমাদের জান?
মানুষটি হাত নেড়ে পুরো বিষয়টি উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, আরে ধেৎ, তোমার জান! এক গ্রুজান গিয়েছে তো আরেক গ্রুজান আসবে। সত্যি কথা বলতে কী গ্রুজান তো আর পুরোপুরি ক্ষতি হয় নি তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি *রে দিয়েছি। কিন্তু তোমাকে তো আমরা পেয়েছি।
আমাকে?
হ্যাঁ। আমরা একটা শিল্প প্রতিষ্ঠান। মানুষ ধরে এনে তাকে বিক্রি করি। কখনো কেটেকুটে কখনো মগজে ইলেকট্রড বসিয়ে কখনো সৈনিক হিসেবে এবং যদি খুব কপাল ভালো হয় তখন আমরা তোমার মতো একজন পাই, যাকে আমরা খেলোয়াড় হিসেবে বিক্রি করতে পারি।