রুহান বিস্ফারিত চোখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটা সত্যি বলছে নাকি ঠাট্টা করছে সে ঠিক বুঝতে পারে না। একজন ভাঙ্গা গলায় বলল, আ-আমরা তোমার সাথে যুদ্ধ করব?
হ্যাঁ। বলতে পার সেটা এক ধরনের যুদ্ধ। তোমরা আমাকে গুলি করবে, আমি তোমাদের গুলি করব।
কিন্তু আমি কখনো কোনো অস্ত্র হাত দিয়ে ধরি নি।
যদি সেটা সত্যি হয় বুঝতে হবে তোমার কপাল খারাপ। তবে বেশি হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আজকালকার অস্ত্র খুব ভালো, খুব তাড়াতাড়ি ব্যবহার করা শেখা যায়।
রুহানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কমবয়সী ছেলেটা হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ল, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, আমি পারব না। আমি পারব না, আমাকে ছেড়ে দাও, প্লীজ।
গ্রুজান হা হা করে হেসে বলল, অবশ্যই আমি তোমাকে ছেড়ে দেব। সামনের এই খাল, পাথর, গাছগাছালির মধ্যে আমি তোমাকে ছেড়ে দেব, শুধু মনে রেখ এইখানে আমি অস্ত্র নিয়ে তোমার দিকে তাক করে থাকব! তোমাকে আমি পাখির মতো গুলি করে মারব। ছিচকাদুনে মানুষ সৈনিক হবার উপযুক্ত নয়।
রুহান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, এখনো পুরো ব্যাপারটি তার বিশ্বাস হচ্ছে। তার ভয় পাবার কথা কিন্তু সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করল তার ভয় করছে। ভেতরে বিচিত্র একধরনের অনুভূতি, ভাবলেশহীন পাথরের মতো শীতল একধরনের অনুভূতি কিন্তু সেই অনুভূতিটি ভয়ের নয়, অন্য কিছুর।
০৪. হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি
হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি নিয়ে ছেলেটি দরদর করে ঘামছে। রুহানের দিকে শূন্য
দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আমি কখনো অস্ত্র ব্যবহার করি নি।
রুহান ছেলেটির কাঁধ স্পর্শ করে বলল, আমরা কেউই করি নি! তাতে কিছু আসে যায় না।
ছেলেটি ভাঙ্গা গলায় বলল, আমাকে মেরে ফেলবে।
সম্ভবত। রুহান নরম গলায় বলল, আপাতত সেটা নিয়ে চিন্তা কর না।
আমি কী করব?
তুম এখন দৌড়ে ঐ দিকে দেয়ালের পিছনে যাবে।
কিন্তু–
রুহান বলল, এর মধ্যে কোনো কিন্তু নেই। এখন ভয় পেলে হবে না। যাও।
আমি কী গুলি করতে করতে যাব?
গুলি করতে করতে দ্রুত ছুটতে পারবে না। কোনো কিছুর আড়ালে থেকে ঐ গ্রুজান জানোয়ারটার দিকে এক পশলা গুলি কর, সে তখন নিজেকে বাঁচানোর জন্যে আড়ালে সরে যাবে। জানোয়ারটা আড়াল থেকে আবার বের হবার আগে ছুটে কোনো একটা কিছুর আড়ালে চলে যাবে। আবার বের হবার আগে আবার এক পশলা গুলি করবে।
ছেলেটি ফ্যাকাসে মুখে বলল, তোমার কী ধারণা তাহলে আমি যেতে পারব?
রুহান হাসার চেষ্টা করে। বলল, হ্যাঁ পারবে অবশ্যই পারবে। যাও।
ছেলেটা চোখ বন্ধ করে একবার সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে তারপর অস্ত্র হাতে এগিয়ে যায়।
দেয়ালের আড়াল থেকে অস্ত্রটা বের করে ছেলেটা ছাড়া ছাড়াভাবে কয়েকটা গুলি করল। জান সম্ভবত এর জন্যে প্রস্তুত ছিল না, তার গলায় কুৎসিত একটা গালি শোনা গেল। ছেলেটা দৌড়ে একটা পাথরের আড়ালে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে একটা বড় গাছের আড়ালে। আবার এক পশলা গুলি করে ছুটে আরেকটা পাথরের আড়ালে চলে গেল। জান সম্ভবত এরকম কিছু আশা করে নি, সে কুৎসিত ভাষায় গালাগাল করতে থাকে এবং তার মধ্যে ছেলেটা অন্যপাশে দেয়ালের আড়ালে চলে গেল।
রুহান মাথা ঘুরিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যদের বলল, দেখেছ?
অন্যেরা মাথা নাড়ল। রুহান বলল, এটাই হবে আমাদের টেকনিক। যাও পরেরজন। খুব সাবধান।
পরেরজনও ছাড়া ছাড়াভাবে গুলি করতে করতে এক পাথর থেকে অন্য পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে অন্য পাশে চলে গেল। তৃতীয়জন রওনা দেবার। আগে রুহানের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আমি পারব না।
কেন পারবে না? দেখছ না দুজন চলে গেছে।
ছেলেটি শূন্য দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ভয় করে।
আমাদের সবার ভয় করে। কিন্তু সে জন্যে বসে থাকলে তো হবে না। যাও।
না। আমি পারব না।
তুমি পারবে। যাও।
ছেলেটা তবুও দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। তখন সামরিক পোশাক পরা একজন এসে ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। ছেলেটা হত বিহ্বলের মতো ফাঁকা জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে থাকে, তাকে যে ছুটে যেতে হবে সেটাও যেন ভুলে গেছে।
রুহান চিৎকার করে বলল, দৌড়াও! দৌড়াও–
ছেলেটা রুহানের দিকে তাকাল, দেখে মনে হলো সে কী বলছে সেটা বুঝতে পারছে না। ঠিক তখন একটা গুলির শব্দ শোনা গেল এবং সাথে সাথে ছেলেটির শরীরটি মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে লাফিয়ে উঠে ধপ করে নিচে পড়ে গেল। রুহান তার চোখটি সরিয়ে নিতে চেষ্টা করল কিন্তু সরাতে পারল না, বিস্ফারিত চোখে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটির মুখে যন্ত্রণার। কোনো চিহ্ন নেই, সেখানে এক ধরনের বিস্ময়।
রুহান নিঃশব্দে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু মানুষের চিৎকার এবং হইচইয়ের শব্দ শোনা যায়। ছেলেটির দেহটি সরিয়ে নিচ্ছে, এক্ষুনি কাটাকাটি করে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সরিয়ে নেবে, তারপর সেগুলো প্যাকেটে সংরক্ষণ করে। চড়া দামে বিক্রি করা হবে।
রুহানের হাতে কে যেন একটা অস্ত্র ধরিয়ে দিয়েছে, রুহান মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। ভাবলেশহীন মুখে একজন মানুষ তাকে স্পর্শ করে বলল, এখন তুমি।
আমি?
হ্যাঁ। যাও।
রুহান সামনের খোলা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে দেখল সেখানে বড় বড় কয়েকটা পাথর। গাছ-গাছালি, ছোট একটা খাল এবং ঝোপঝাড়। তার ভেতর দিয়ে তাকে ছুটে যেতে হবে। সে যখন ছুটে যাবে তখন গ্রুজান তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে তাক করে থাকবে তাকে গুলি করে মেরে ফেলার জন্যে। এটা যেন একটা খেলা। যাদের নিয়ে এই খেলাটি খেলা হচ্ছে তারা যেন মানুষ নয়, তারা যেন খেলার গুটি।