বন্ধ ঘর থেকে বের হতে পেরে রুহান এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করে। উপরে নীল আকাশ মাঝে মাঝে শরতের মেঘ। বড় বড় পাথরে ঢাকা পাহাড়ী অঞ্চল তার মাঝে নানা ধরনের গাছ-গাছালি, জায়গাটা একটা সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মতো। রুহান অন্য সবার সাথে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। অপেক্ষা করতে করতে যখন অধৈর্য হয়ে পড়ছিল ঠিক তখন কঠোর চেহারার একজন মাষ তাদের সামনে এসে দাঁড়াল, মাথার টুপিটা পিছনে সরিয়ে শুকনো খসখসে গলায় বলল, আমার নাম গ্রুজান। এই জায়গাটাকে সবাই আদর করে ডাকে গ্রুজানের নরক। তোমাদের সবাইকে গ্রুজানের নরকে আমন্ত্রণ।
রুহান গ্রুজান নামের এই মানুষটাকে ভালো করে লক্ষ্য করল। রোদে পোড়া তামাটে চেহারা, নীল চোখগুলো অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো। সেখানে এক ধরনের অমানবিক নিষ্ঠুরতা উঁকি দিচ্ছে, হঠাৎ চোখ পড়লে বুক কেঁপে ওঠে।
গ্রুজান সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, তোমাদের এখানে কেন আনা হয়েছে জান?
কেউ কোনো কথা বলল না, একজন অনিশ্চিতের মতো মাথা নেড়ে বলল, না।
না জানাটাই ভালো ছিল, কিন্তু এখন তোমাদের জানতে হবে। এই এলাকাটা যেরকম গ্রুজানের নরক, এর বাইরে আরেকটা বড় নরক আছে। সেটার নাম পৃথিবী। পৃথিবী নামের এই নরকে এখন মারামারি কাটাকাটি চলছে। পৃথিবীর মানুষ প্রথম ভেবেছিল মারামারি কাটাকাটি বুঝি খুব খারাপ জিনিস–কিন্তু এখন দেখেছে এটা মোটেও খারাপ না, এটা অন্যরকম একটা জীবন। যারা সেটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তার এখন মহানন্দে আছে।
রুহান এক ধরনের অবিশ্বাস নিয়ে জান নামের মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে। জান নিঃশব্দে তাদের সবার সামনে দিয়ে একটু হেঁটে আবার আগের জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে বলল, পৃথিবীতে যখন মারামারি কাটাকাটি শুরু হয় তখন একটা জিনিসের খুব অভাব হয়। সেটা কী বলতে পারবে?
রুহানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কমবয়সী একটা ছেলে নিচু গলায় বলল, শুভ বুদ্ধি।
কী বললে? শুভ বুদ্ধি? জান কয়েক মুহূর্ত ছেলেটির দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ করে বিকট গলায় হাসতে শুরু করে, কিছুতেই হাসি থামাতে পারে না। শেষ পর্যন্ত অনেকটা জোর করে হাসি থামিয়ে চোখ মুছে বলল, না ছেলে, শুভ বুদ্ধি না। শুভ ন্যায় সত্য এই সব কথাগুলো বড় বড় কথা, কিন্তু আসলে এগুলো হচ্ছে অর্থহীন কথা। পৃথিবীতে শুভ ন্যায় সত্য বলে কিছু নেই। যার জোর বেশি সে যেটা বলবে সেটাই হচ্ছে সত্য। সেটাই ন্যায়। সেটাই শুভ। বুঝেছ?
কেউ কোনো কথা বলল না। জান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীতে মারামারি কাটাকাটি শুরু হবার পর যে জিনিসটার অভাব হয়েছে সেটা হচ্ছে বডি পার্টস। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। যুদ্ধে যারা মারা যায় তারা তো মরেই গেল। কিন্তু যারা বেঁচে থাকে তাদের কারো দরকার হৃৎপিণ্ড। কারো দরকার। কিডনি। কারো ফুসফুস। কারো হাত, কারো পা। কারো চোখ। কার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে দাম। জান চোখ নাচিয়ে বলল, তোমাদের শরীরে আছে সেই সব অদৃশ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। আমরা তোমাদের ধরে এনেছি সেগুলো কেটেকুটে বিক্রি করার জন্যে। তোমরা সবাই হচ্ছ আমাদের মূল্যবান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাপ্লাই। বুঝেছ?
রুহান এবং তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য কয়েকজন এক ধরনের ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে। সত্যিই কী তাদের কেটেকুটে মেরে ফেলার জন্যে ধরে এনেছে?
গ্রুজান চোখে মুখে এক ধরনের পরিতৃপ্তির ভাব নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে দেখেই বোঝা যায় সে সবার আতঙ্কটুকু উপভোগ করছে। মুখে লোল টানার মতো এক ধরনের শব্দ করে বলল, তবে আমরা একটা শিল্প প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে কাঁচামাল এনে সেটাকে প্রক্রিয়া করে মূল্যবান জিনিস বানাই। তোমরা হচ্ছ কাঁচামাল, তোমাদের প্রক্রিয়া করে আরো মূল্যবান করা হচ্ছে আমাদের উদ্দেশ্য। সেটা কীভাবে করা যায় জান?
কেউ কোনো কথা বলল না, জানও সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। বলল, তোমাদের মধ্যে যাদের মগজ ভালো তাদের মাথায় একটা ইলেট্রড ঢুকিয়ে খুব ভালো দামে বিক্রি করা যায়। তোমাদের মধ্যে যাদের মগজ ভালো এর মাঝে তাদের আলাদা করা হয়েছে–তোমরা তার মাঝে নেই। তোমরা হচ্ছ গাধা টাইপের। বুঝেছ? তোমাদের রাখা হয়েছে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করার জন্যে। তবে–
গ্রুজান খানিকটা নাটকীয় ভাব করে হঠাৎ থেমে গিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর চোখ নাচিয়ে বলল, তোমাদের জানে বেঁচে যাবার এখনো খুব ছোট একটা সম্ভাবনা আছে। খুবই ছোট। সেটা কী জানতে চাও?
এবারেও কেউ কোনো কথা বলল না।
আমরা বাজার যাচাই করে দেখেছি, তোমাদের কেটেকুটে বিক্রি করে আমরা যে পরিমাণ ইউনিট পাই, তার থেকে অল্প কিছু বেশি ইউনিট পাওয়া যায় যদি তোমাদের একজনকে সৈনিক হিসেবে বিক্রি করা যায়। তবে সমস্যাটা কী জান?
কয়েকজন দুর্বলভাবে মাথা নেড়ে জানাল যে তারা সমস্যাটা জানে না। জান মুখে এক ধরনের হাসি টেনে এনে বলল, সমস্যাটা হচ্ছে সবাইকে। সৈনিক বানানো যায় না। শুধু তারাই সৈনিক হতে পারে, যাদের বুকে আছে সাহস এবং যাদের রিফ্লেক্স খুব ভালো। যারা শক্তিশালী এবং যারা কষ্ট সহ্য করতে পারে।
গ্রুজান নিঃশব্দে তাদের সামনে দিয়ে একটু হেঁটে এসে বলল, তোমাদের কেটেকুটে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করার আগে তাই আমরা তোমাদের সৈনিক হবার একটা সুযোগ দিই। সুযোগটা হচ্ছে এরকম-ঐ যে দূরে দেয়ালটা দেখছ সেই দেয়ালের আড়ালে তোমরা দাঁড়াবে। যখন আমি তোমাদের সংকেত দেব তখন সেখান থেকে বের হয়ে এই গাছগাছালী, পাথর, খাল, মাঠ পার হয়ে অন্য পাশের দেওয়ালের আড়ালে ছুটে যাবে। তোমার হাতে থাকবে একটা অস্ত্র, তুমি চাইলে সেটা ব্যবহার করতে পার। আমি এখান থেকে তোমাদের গুলি করে মেরে ফেলার চেষ্টা করব। বুঝেছ?