তাহলে সংখ্যাগুলো মনে রাখব কেমন করে?
সংখ্যাগুলো তোমার মাথায় রাখতে হবে।
মাথায়?
হ্যাঁ। বন্ধ কর।
রুহান অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মানুষ দুজনের দিকে তাকিয়ে ক্রিস্টাল রিডার বন্ধ করে দিল। বয়স্ক মানুষটি বলল, সংখ্যাগুলো হচ্ছে এক এক দুই তিন পাঁচ আট তেরো একুশ চৌত্রিশ–
ক্রিস্টাল রিডারটি চালু থাকলে সংখ্যাগুলো সেখানে রেকর্ড হয়ে যেত, তাকে নিচু গলায় শুনিয়ে দিত। এখন পুরোটা তাকে মনে রাখতে হচ্ছে। সংখ্যা হলো এক এক দুই তিন পাঁচ আট-হঠাৎ করে রুহান বুঝে ফেলে আগের দুটি সংখ্যা যোগ করে পরের সংখ্যাটি তৈরি হচ্ছে। তার মানে তারা যে সংখ্যাটি জানতে চাইছে সেটি হচ্ছে একুশ এবং চৌত্রিশের যোগফল, পঞ্চান্ন। রুহান একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পঞ্চান্ন।
মানুষ দুজনই এবারে সোজা হয়ে বসল। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় কিছু একটা বলল, তারপর আবার রুহানের দিকে তাকাল। তুলনামূলকভাবে কমবয়সী মানুষটি বলল, আমি তোমাকে ত্রিমাত্রিক একটা ছবি দেখাব। ছবিটি দেখে তোমাকে তার পৃষ্ঠদেশের ক্ষেত্রফল বলতে হবে।
আমি কী এবার ক্রিস্টাল রিডারটি চালু করতে পারি?
মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, না।
রুহান একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে।
মানুষটি টেবিল থেকে একটা কার্ড তুলে সোজা করে ধরল। বেশ কয়েকটি টিউব দিয়ে তৈরি একটি ত্রিমাত্রিক ছবি। পৃষ্ঠদেশের ক্ষেত্রফল বের করার জন্যে সামনে পিছনে ডানে বামে এবং উপর নিচে এই ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে টিউবগুলোর ক্ষেত্রফল বের করে যোগ দিতে হবে। ছবিটির দিকে তাকিয়ে রুহান হঠাৎ করে বুঝতে পারে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে এর ক্ষেত্রফল বের করা সম্ভব। টিউবগুলো গুনে সেটাকে ছয় গুণ করতে হবে। সেখান থেকে যে পৃষ্ঠাগুলো একটা আরেকটাকে স্পর্শ করে আছে সেগুলো বাদ দিতে হবে। রুহান চট করে ত্রিমাত্রিক ছবিটির ক্ষেত্রফল বের করে নেয়।
কমবয়সী মানুষটি জিজ্ঞেস করল, কত?
উত্তরটা বলতে গিয়ে হঠাৎ রুহান থমকে গেল। তাদের যখন লরি করে আনছিল তখন মানুষগুলো তাদের একটা কথা বলেছিল। তারা বলেছিল যাদের বুদ্ধি থাকে তাদের মগজে ইলেকট্রড ঢুকিয়ে সেটাকে ব্যবহার করা হয়। তার বুদ্ধির পরীক্ষা নিচ্ছে, সে যদি এই পরীক্ষায় ভালো করে তাহলে কী তার মগজেও ইলেকট্রড ঢুকিয়ে দেবে? সর্বনাশ!
কী হলো? কমবয়সী মানুষটি বলল, উত্তর দাও।
রুহান উওর দিল। সঠিক উত্তরটি না দিয়ে সে একটা ভুল উত্তর দিল। সঠিক উত্তরের কাছাকাছি একটা ভুল উত্তর।
কমবয়সী মানুষটার চোখে মুখে একটা আশাভঙ্গের ছাপ পড়ে। সে খানিকটা কৌতূহল নিয়ে বলল, ঠিক করে বল।
রুহান আবার চিন্তা করার ভান করে নতুন একটা উত্তর দিল। সেটিও ভুল।
মানুষ দুজন আবার একজন আরেকজনের দিকে তাকায় তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে। রুহান চোখে মুখে হতাশার চিহ্ন ফুটিয়ে বলল, হয় নি?
না।
ক্রিস্টাল রিডারটা চালু করলেই বলতে পারতাম।
ক্রিস্টাল রিডার ছাড়াই বলতে হবে। এটাই নিয়ম।
ও।
বয়স্ক মানুষটি গোমড়া মুখে বলল, ঠিক আছে তোমাকে আবার কয়েকটি সংখ্যা বলি, তুমি তার পরেরটা বলবে।
ঠিক আছে। বল।
মানুষটা একটা কার্ড দেখে বলল, এক দুই দুই চার তিন আট চার ষোল।
রুহান সংখ্যাগুলো মনে রাখার চেষ্টা করে। সবসময় ক্রিস্টাল রিডার ব্যবহার করে কাজ করে এসেছে, কিছু একটা মনে রাখতে হলে ক্রিস্টাল রিডার সেটা মনে রেখেছে। যখন প্রয়োজন তাকে পড়ে শুনিয়েছে কিন্তু নিজের কানে শুনে নিজে মনে রাখা সম্পূর্ণ অন্য একটা ব্যাপার। রুহান সংখ্যাগুলো মাথার মাঝে সাজিয়ে নিয়ে ভেতরের মিলটুকু খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় কোনো মিল নেই কিন্তু একটু চিন্তা করতেই হঠাৎ করে পুরোটুকু স্পষ্ট হয়ে যায় এর মাঝে দুটো ধারা লুকানো, একটি এক দুই তিন চার অন্যটি দুই চার আট ষোল, তাই এর উত্তর হচ্ছে পাঁচ। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
বয়স্ক মানুষটি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, কত?
রুহান নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, জানি না।
জানি না বললে হবে না। একটা উত্তর দিতে হবে।
ঠিক আছে। রুহান সরলভাবে বলল, বত্রিশ।
বয়স্ক মানুষটা বলল, হয় নি।
তাহলে কী চব্বিশ?
না। এবারেও হয় নি?
রুহান বলল, আমি দুঃখিত।
বয়স্ক মানুষটা বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে একটা ক্রিস্টাল রিডারে কিছু একটা রেকর্ড করিয়ে নিয়ে রুহানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, পাশের ঘরে যাও।
আমি কী পাস করেছি?
না, তুমি পাস করো নি। প্রথমে ভেবেছিলাম পাস করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত করতে পার নি।
কম বয়সী মানুষটা বলল, সেটা নিয়ে মন খারাপ করো না। তারপর নোংরা হলুদ দাঁত বের করে হেসে বলল, তোমার কপাল ভালো যে পাস কর নাই। এই পরীক্ষায় পাস করলে কপালে দুঃখ আছে।
মানুষ দুজন দুলে দুলে হাসতে থাকে এবং সেটা দেখে রুহান কেমন যেন। শিউরে ওঠে। সে খুব বাচা বেঁচে গেছে, আর একটু হলেই এরা তার মাথায়। ইলেকট্রড বসিয়ে দিত।
রুহান পাশের ঘরের দিকে রওনা দেয়, ঘরটি বেশ দূরে এবং সেখানে যাবার জন্যে তাকে একটা সরু করিডোর ধরে হেঁটে যেতে হলো। যেতে যেতে সে গুলির শব্দ শুনতে পায়। থেমে থেমে এবং মাঝে মাঝে একটানা সে কোথায়। গাছে না জানলে এটাকে একটা যুদ্ধক্ষেত্র বলে ধরে নিত।
করিডোরের শেষে যে ঘরটিতে সে হাজির হলো সেটাকে দেখে একটা যুদ্ধক্ষেত্রের কমান্ড সেন্টার বলে মনে হতে পারে। রুহানের মতো আরো কয়েকজন সেখানে এর মাঝে হাজির হয়েছে, তাদের সবাইকে এক ধরনের সামরিক পোশাক পরানো হয়েছে। রুহানকেও সেটা পরতে হলো এবং তারপর তাদেরকে একটা ছোট দরজা দিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো।