প্রথমে কিছুক্ষণ রুহানের ভেতর খানিকটা কৌতূহল ছিল। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একসময় তার কৌতূহলটুকু উবে গেল। শেষ পর্যন্ত তাকে যখন ছোট ঘরটিতে ডেকে নেয়া হলো তখন রুহানের ভেতরে এক ধরনের ক্লান্তি এসে ভর করেছে।
ছোট ঘরটিতে একটা উঁচু বিছানা, তার পাশে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাটি তার দিকে কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ো।
রুহান কোনো কথা না বলে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মহিলাটি উপর থেকে কিছু যন্ত্রপাতি নামিয়ে এনে তাকে পরীক্ষা করতে থাকে। ত্বক থেকে টিস্যু নিয়ে জিনেটিক কোডিং করা হলো, রক্ত নিয়ে তার শ্রেণীবিভাগ করা হলো, রক্তচাপ মাপা হলো, শরীরের ঘনত্ব মেপে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিন্যাস নির্ধারণ করা হলো, নিউরনের সংখ্যা সিনাঙ্গের ঘনত্ব পরীক্ষা করা হলো সবশেষে তার হাতের ত্বকে ছ্যাকা দিয়ে বেগুনি রঙের একটা বিদঘুটে চিহ্ন একে দেয়া হলো।
রুহান হাতটা নিজের কাছে টেনে এনে বলল, এটা তুমি কী করলে?
মহিলাটি একটু অবাক হয়ে রুহানের দিকে তাকাল, মনে হলো সে কারো প শুনতে অভ্যস্ত নয়। মহিলাটি প্রশ্নের উত্তর দেবে রুহান সেটা আশা করেনি। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মহিলাটি খসখসে গলায় বলল, এটা তোমার কোড। তোমার ত্বক কেটে পাকাপাকিভাবে লিখে দেয়া হয়েছে, এটা কখনো মুছে যাবে না।
রুহান ক্রুদ্ধ চোখে তার হাতের উপর একে দেয়া বিদঘুটে চিহ্নগুলো পরীক্ষা করতে করতে বলল, আমার কোডটা কী অন্যভাবে দেয়া যেত না?
আমরা এমনভাবে দিই যেন আমাদের কোড রিডার সেটা পড়তে পারে।
তোমাদের কোড রিডার?
হ্যাঁ। তোমার তথ্যগুলো আমাদের তথ্যকেন্দ্রে রাখতে হবে।
তার জন্যে আরো আধুনিক কোনো উপায় ব্যবহার করা যেত না? কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতি, কোনো বায়োজিনেটিক পদ্ধতি
মহিলাটির মুখে প্রথমবার এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে, একজন মানুষের চেহারায় যত নিষ্ঠুরতার ছাপই থাকুক না কেন, হাসি সেটা সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু কোনো একটি বিচিত্র কারণে এই মহিলার বেলায় সেটি ঘটল না, তার মুখের হাসিতে তাকে কেমন যেন ভয়ঙ্কর দেখাতে থাকে। মহিলাটি সেই ভয়ঙ্কর মুখে ফিস ফিস করে বলল, ছেলে, তুমি পৃথিবীর কোনো খবর রাখ না?
রুহান একটু অবাক হয়ে বলল, কেন? কী হয়েছে?
পৃথিবীতে এখন ইলেকট্রনিক্স বা বায়োজিনেটিক পদ্ধতি বলে কিছু নেই। পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান নেই। কোনো প্রযুক্তি নেই। পৃথিবী এখন অন্ধকারের দিকে এগোচ্ছে! যে যত তাড়াতাড়ি এই অন্ধকারে অভ্যস্ত হতে পারবে সে তত বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে। বুঝেছ?
রুহান তার হাতের বিচিত্র চিহ্নগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এই চিহ্নগুলো সেই অন্ধকারের চিহ্ন?
হ্যাঁ। প্রাচীনকালে মানুষ তাদের পশুদের হিসেব রাখার জন্যে লোহার শিক গরম করে কিছু চিহ্ন এঁকে দিত। এখন আমরা সেটা মানুষের জন্যে করি। মহিলাটি স্থির চোখে রুহানের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বুঝেছ?
বুঝেছি।
চমৎকার! এখন পাশের ঘরে যাও।
রুহান পাশের ঘরে যাবার জন্যে উঁচু বিছানা থেকে নেমে এলো। মহিলাটি বের হবার দরজাটি দেখিয়ে বলল, আর শোনো। তোমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার আগে কথা বলবে না। এটা স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি না, এখানে শেখার কিছু নেই। এটা একটা দোকান ঘর। তোমাদের ধরে এনে তোমাদের দাম ঠিক করা হচ্ছে, তার বেশি কিছু নয়।
রুহান পাশের ঘরে যেতে যেতে থেমে গিয়ে বলল, প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে কী হয়?
সেটা জানার জন্যে আগ্রহ দেখিও না। যাও। বিদায় হও।
রুহান পাশের ঘরে এসে দাঁড়াল। এখানে বসার জন্যে একটা চেয়ার, সামনে নিচু টেবিল। সেখানে বিচিত্র কিছু জিনিস। টেবিলের অন্য পাশে দুটি চেয়ারে দুজন মানুষ বসে আছে, মানুষ দুজনের মুখ ভাবলেশহীন, তারা রুহানের দিকে তাকিয়ে তাকে বসার জন্যে ইঙ্গিত করল।
রুহান বসে টেবিলের উপরে ভালো করে তাকায়, নানা ধরনের জ্যামিতিক নকশা, কিছু কাগজ, কিছু বিচিত্র ছবি তার সাথে ছোটখাটো কিছু যন্ত্রপাতি। মানুষ দুজনের একজন বলল, দেখি তোমার হাতটা দেখাও।
রুহান একটু আগে বিদঘুটে চিহ্ন এঁকে দেয়া হাতটা মানুষটার সামনে এগিয়ে দেয়। চিহ্নগুলোতে কিছু একটা ছিল যেটা দেখে মানুষটা একটু সোজা হয়ে বসে রুহানকে ভালো করে দেখল। সে টেবিল থেকে একটা ছবি তুলে এনে রুহানকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, এটা কীসের ছবি?
ছবিটা দেখে মনে হয় সেখানে সাদা এবং কালো রং বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, কিন্তু রুহান একটু ভালো করে দেখেই বুঝতে পারল, আসলে ছবিটি একটি মেয়ের। কালো চুল ছড়িয়ে সবগুলো দাঁত বের করে হাসছে, চট করে সেটা বোঝা যায় না। রুহান বলল, এটা একটা মেয়ের ছবি।
মানুষ দুজন এবার নিজেদের ভেতর দৃষ্টি বিনিময় করল। সম্ভবত খুব বেশি মানুষ বিক্ষিপ্ত সাদা কালো রঙের মাঝে মেয়ের ছবিটি খুঁজে পায় না। দুজন মানুষের ভেতর তুলনামূলকভাবে বয়স্ক মানুষটি গলা পরিষ্কার করে বলল, আমি তোমাকে কয়েকটা সংখ্যা বলব। সেগুলো শুনে তুমি তার পরের সংখ্যাটি বলবে।
রুহান তার গলায় ঝোলানো ক্রিস্টাল রিডারটি হাত দিয়ে স্পর্শ করে বলল, ঠিক আছে।
তার আগে তোমার ক্রিস্টাল রিডার বন্ধ করে নাও।
রুহান অবাক হয়ে বলল, ক্রিস্টাল রিডার বন্ধ করে নেব?
হ্যাঁ।