আমি বললাম, তোমার এই পোশাক যদি পছন্দ করে, বুঝতে হবে এর মাথায় বড় ধরনের গোলমাল আছে।
মা একটু রেগে বললেন, বাজে বকিস না। কোথা থেকে এসেছে, কী রকম কাপড় পরে অভ্যাস কে জানে, একটু ঢিলেঢালা কাপড়ই ভালো।
তরুণটির চেহারা অসম্ভব সুন্দর, শুধুমাত্র সে কারণে আমার মায়ের তৈরি একটি বিচিত্র পোশাকেও তাকে চমৎকার মানিয়ে গেল। পোশাক শেষ করে মা। এবারে তার খাবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার সাথে দেখা হয়েছে প্রায় আঠারো ঘন্টা হয়ে গেছে, এই দীর্ঘ সময়ে সে কিছু খায় নি। সময় নিয়ে নানারকম খাবার তৈরি করে মা আবার তরুণটিকে খাবার জন্যে ডেকে আনলেন। খাবার টেবিলে বসতে গিয়েও তরুণটিকে বেশ কসরত করতে হল বলে মনে হল। তার প্লেটে খাবার তুলে দেয়া হল এবং আমরা নানাভাবে তাকে খাবার মুখে দিতে ইশারা করতে থাকি, কিন্তু সে খাবার মুখে দিল না। আমি মাকে বললাম, মা, তোমার কথাই ঠিক। এ আসলেই ঈশ্বরের দূত।
এ জন্যে কিছু খেতে হয় না। বাতাস খেয়ে থাকে।
মা আবার আমার উপর রেগে গেলেন, বললেন, বাজে বকিস না। কী খায়, কী খেয়ে অভ্যাস কে জানে, একটা কিছু দিলেই কি খেতে পারবে?
মা’কে খুশি করানোর জন্যেই কি না জানি না, তরুণটি হঠাৎ হাত বাড়িয়ে এক টুকরা মাংস তুলে নিয়ে খানিকক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করে খুব সাবধানে একটু কামড়ে নিয়ে ধীরে ধীরে চিবুতে থাকে। তার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। খাবারটি তার পছন্দ হয়েছে কি না। আমরা যতক্ষণ আমাদের খাবার শেষ করলাম তরুণটি ততক্ষণ ঐ মাংসের টুকরাটি নিয়ে বসে রইল। ছোট শিশু যেরকম বড় একটি মিষ্টি হাতে নিয়ে বসে থেকে ধীরে ধীরে চুষে খেতে থাকে, তরুণটির খাওয়ার ধরনটি অনেকটা সেরকম।
খেতে খেতে মা তরুণটির সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেন। আমাকে দেখিয়ে বললেন, এর নাম কুনিল। কু-নিল।
তারপর তরুণটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, তোমার নাম কি?
উত্তরে তরুণটি মধুরভাবে হাসল। মধুর হাসি নিশ্চয়ই কারো নাম হতে পারে না। মা আবার চেষ্টা করলেন, আমাকে দেখিয়ে বললেন, এর নাম কু-নি-ল। তারপর নিজেকে দেখিয়ে বললেন, আমার নাম লানা। আমি কনিলের মা। তোমার নাম কি?
তরুণটি উত্তরে কিছু না বলে আবার মধুরভাবে একটু হেসে দিল।
আমি বললাম, এর নাম হচ্ছে মধুর হাসি—দেখছ না কেমন মধুরভাবে হাসছে।
মা বললেন, বাজে কথা বলবি না।
বোকা-হাসিও বলতে পার। বোকার মতো হাসি।
চুপ কর।
সংক্ষেপে বুকাস! বুকাস নামটা খারাপ না। কি বল।
ফাজলেমি করবি না।
ঠিক আছে, তাহলে রুকাস! আমি তুরুণটির দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার নাম রুকাস।
তরুণটি প্রথমবার কথা বলল, আস্তে আস্তে বলল, রুকাস। এক জন মানুষের গলার স্বর এত সুন্দর হতে পারে, আমি নিজের কানে না শুনলে কখনো বিশ্বাস করতাম না। আমি নিজেকে দেখিয়ে বললাম, আমার নাম কুনিল।
তরুণটি আবার আস্তে আস্তে বলল, কুনিল।
আমি তরুণটিকে দেখিয়ে বললাম, তোমার নাম—রুকাস।
রুকাস।
নামটি নিশ্চয়ই তার পছন্দ হয়েছে, কারণ বেশ আপন মনে কয়েকবার বলল, রুকাস। রু-কাস। রুকাস। রুকাস।
মা উষ্ণ স্বরে বললেন, কেন ছেলেটিকে জ্বালাতন করছিস?
কিসের জ্বালাতন? নাম ছিল না, তাই নাম দিয়ে দিলাম।
মা হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে মাথা নাড়লেন।
বিকেলবেলা আমি তরুণটিকে নিয়ে হাঁটতে বের হলাম। কিরীণার বাসার পাশে দিয়ে যাবার সময় আমাদের দেখে কিরীণা ছুটে এল। তরুণটিকে দেখে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল, এত সুন্দর চেহারা তরুণটির, কিরীণা যে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে বিচিত্র কি? আমি আমার বুকে ঈর্ষার একটা সূক্ষ্ম খোঁচা বোধ করতে থাকি।
কিরীণা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, এ কে?
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, কেউ জানে না এ কে।
কোথা থেকে এসেছে?
কেউ জানে না।
তাহলে কেমন করে এল?
সেটাও কেউ জানে না।
কিরীণা আমার বুকে একটা ছোট ধাক্কা দিয়ে বলল, ছাই ঠিক করে বল না কী হয়েছে? আমি তখন কিরীণাকে সবকিছু খুলে বললাম। গভীর রাতে তার সামনে সমুদ্রের ঢেউ কেমন করে পিছিয়ে যাচ্ছিল শুনে কিরীণার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। গল্প শেষ করে আমি গলা নামিয়ে বললাম, যা মনে করে এ হচ্ছে ঈশ্বরের দূত।
কিরীণা বুকে হাত দিয়ে বলল, নিশ্চয়ই ঈশ্বরের দূত। নিশ্চয়ই।
ছোট বাচ্চারা অর্থহীন কথা বললে বড়রা যেরকম করে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে তাদের দিকে তাকায়, আমি ঠিক সেভাবে কিরীণার দিকে তাকালাম। কিরীণা আবার রাগ হয়ে আমার বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল, তুমি বিশ্বাস কর না বলে অন্যেরাও বিশ্বাস করতে পারবে না?
আমি আর কোনো প্রতিবাদ করলাম না। কিরীণার অনেক অর্থহীন কথাবার্তা আমি সত্ম করি।
এখন তোমরা কোথায় যাও?
ইলির কাছে।
কেন?
দেখি ইলি কিছু বলতে পারে কি না। তুমি যাবে আমার সাথে?
কিরীণা একটু ইতস্তত করে রাজি হল।
তরুণটিকে দেখে ইলি খুব অবাক হল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইলি, এ কি ট্রন?
মনে হয় না। এর চেহারা ট্রনেদের মতো নয়।
তাহলে এ কে? কোথা থেকে এসেছে?
সেটা তো আমি জানি না। ইলি খানিকক্ষণ চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থেকে বলল, আমার কাছে নূতন একটা যন্ত্র এসেছে, সেটা দিয়ে পরীক্ষা করতে পারি।
কি যন্ত্র?
মানুষের জিনস বিশ্লেষণ করে তার সম্পর্কে বলে দেয়। কোন জাতি, কোন দেশের মানুষ, কোথায় অবস্থান এইসব।
কেমন করে কাজ করে এটা?
এক ফোঁটা রক্ত দিতে হয়। দেখি, তোমারটা দিয়ে শুরু করি।