কোনো কাজ নেই বলে সকাল সকাল শুয়ে পড়লাম। মা তরুণটির জন্যে একটি উঃ বিছানা তৈরি করে দিলেন কিন্তু সে জানালার কাছেই দাঁড়িয়ে রইল। আমি নিজের বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঝড়ের শব্দ শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
আমার ঘুম ভাঙল মায়ের আর্তচিৎকারে। ধড়মড় করে উঠে বসলাম আমি, মা হাতে একটা মোমবাতি নিয়ে আমাকে ঝাকাতে ঝাঁকাতে বললেন, ওঠ, ঘুম থেকে ওঠ, সর্বনাশ হয়েছে, সর্বনাশ–
কী হয়েছে মা? কি?
পানি আসছে। পানি–
আমি লাফিয়ে বিছানা থেকে নামলাম, আমাদের বাসাটি একটি পাহাড়ের পাদদেশে, বড় জলোচ্ছ্বাস এলে পুরো বাসাটি পানিতে তলিয়ে যাবার কথা। আগেও কয়েকবার আমরা খুব অল্প সময়ের মাঝে বাসা ছেড়ে পাহাড়ে উঠে গেছি। ব্যাপারটিতে সেরকম কোনো ভয় নেই, সত্যি কথা বলতে কি, আমার প্রত্যেকবারই কেমন একধরনের ফুর্তি হয়েছে। মায়ের কথা অবশ্যি ভিন্ন, তিনি আতঙ্কে অধীর হয়ে প্রত্যেকবারই মৃতপ্রায় হয়ে গেছেন।
আমি উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। গাঢ় অন্ধকার নেই, আবছা আলোতে বেশ দেখা যায়। সমুদ্র ফুসে উঠছে, বড় বড় ঢেউয়ে পানি অনেকদূর এগিয়ে এসেছে। আমি পাহাড়ের উপরে তাকালাম, একটা লাল বাতি জ্বলছে এবং নিতছে। তার মানে মায়ের আতঙ্কট অহেতুক নয়, সত্যি সত্যি বড় জলোচ্ছাস আসছে।
আমি জুতো পরছিলাম, মা তাড়া দিলেন, এখন এত সাজগোজের দরকার কি?
সাজগোজ কোথায় দেখলে? খালিপায়ে যাব নাকি?
পাগল ছেলেটাকে নিতে হবে আবার!
আমার হঠাৎ তরুণটির কথা মনে পড়ল। জিজ্ঞেস করলাম, কী করছে মা?
জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঘুমায় নি?
না। ওঠ এখন, বের হতে হবে। মা ছুটে গিয়ে তরুণটির হাত ধরে টেনে আনলেন। সে একটু অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল, কিন্তু বের হয়ে আসতে আপত্তি করল না। বাইরে বৃষ্টিটা কমেছে, কিন্তু প্রচণ্ড বাতাস। আমি লাফিয়ে লাফিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকি, পিছনে মা তরুণটিকে হাত ধরে আনছেন। একটু উঠে পিছনে তাকালাম, হঠাৎ অবাক হয়ে দেখলাম, তরুণটি সোজা সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর মা তারস্বরে চিৎকার করছেন। আমি ছুটে গিয়ে তরুণটিকে ধরার চেষ্টা করলাম, কিন্তু অসম্ভব শক্তি এই বিচিত্র তরুণটির। আমাকে প্রায় ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সোজা সমুদ্রের দিকে হেঁটে গেল। ভয়ংকর একটা ঢেউ ছুটে আসছে। আমি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম, মুহূর্তে ঢেউটি এই তরুণটিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে উন্মত্ত সমুদ্রে। কিন্তু একটা খুব বিচিত্র ব্যাপার ঘটল, ভয়ঙ্কর ঢেউটি হঠাৎ করে ভেঙে গেল তার পায়ের কাছে। পানির ঢল হয়ে নিচে নেমে গেল ঢেউটি।
তরুণটি আরো এগিয়ে যায়, পানির বড় আরেকটা ঢেউ আবার আঘাত করতে এগিয়ে এসে পায়ের কাছে চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যায়। কী আশ্চর্য! তরুণটি কেমন করে জানল এটি ঘটবে? কী বিচিত্র আত্মবিশ্বাসে সে এগিয়ে যাচ্ছে উন্মত্ত সমুদ্রের দিকে, আর কী সহজে উন্মত্ত সমুদ্র বশ মেনে যাচ্ছে এই তরুণের কাছে!
আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। মা আমার পাশে এসে দাঁড়ান। ফিসফিস করে বলেন, কুনিল। দেখেছিস?
কী হচ্ছে এটা মা? সত্যি কি হচ্ছে?
হ্যাঁ বাবা। আমি দেখে বুঝেছিলাম এ সাধারণ মানুষ নয়।
তাহলে কে?
ঈশ্বরের দূত। মা ফিসফিস করে প্রার্থনা শুরু করলেন, হে পরম করুণাময় ঈশ্বর। দয়া কর। দয়া কর। দয়া কর।
আরেকটি ভয়াবহ ঢেউ ছুটে আসছে মূর্তিমান বিভীষিকার মতো। তরুণটি ভ্রুক্ষেপ না করে এগিয়ে যায় আর সেই ভয়াবহ জলরাশি আবার পায়ের কাছে চুর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। তরুণটি মাথা উঁচু করে হেঁটে যাচ্ছে, আর বিশাল জলরাশি মাথা নিচু করে পিছিয়ে যাচ্ছে। গায়ের সাদা চাদর উড়ছে বাতাসে, মনে হচ্ছে সত্যিই সে নেমে এসেছে স্বর্গ থেকে ঈশ্বরের আহ্বানে। তার সামনে মাথা নত করে ফেলছে প্রকৃতি, উন্মত্ত সমুদ্র, ভয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাস।
মা আবার ফিসফিস করে বললেন, ঈশ্বর আমাদের দিকে মুখ চেয়ে তাকিয়েছেন। তাঁর দূত পাঠিয়েছেন আমাদের কাছে। দেখু কুনিল, তাকিয়ে দেখ! হা ঈশ্বর! হা ঈশ্বর।
আমি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিলাম, কিন্তু তবু মায়ের কথার সাথে একমত হতে পারলাম না। আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, এই পৃথিবীতে যে ভয়ঙ্কর অত্যাচার করা হয়, এক জন ঈশ্বর থাকলে তিনি সেটা করতে দিতেন না। আর সেটা যদি করতে দিয়ে থাকেন, হঠাৎ করে একটি জলোচ্ছ্বাস থামিয়ে দেওয়ার জন্যে এক জন উলঙ্গ দূত পাঠিয়ে দেবেন না। আমাদের জন্যে ঈশ্বরের বিন্দুমাত্র ভালবাসা নেই। বিন্দুমাত্রও নয়।
এই তরুপটি মানসিক ভারসামহীন একটি তরুণ। নির্বোধের মতো সে জলোচ্ছ্বাসের মাঝে ঝাঁপ দিতে গিয়েছিল। ঘটনাক্রমে ঠিক সেই মুহূর্তে জলোচ্ছাস সরে গিয়েছে। মানসিক ভারসামাহীন এই তরুণ এক জন ভাগ্যবান তরুণ—অসম্ভব ভাগ্যবান এক জন তরুণ। তার বেশি কিছু নয়।
আমি অবাক বিস্ময়ে মানসিক ভারসাম্যহীন এই অস্বাভাবিক ভাগ্যবান তরুণটির দিকে তাকিয়ে থাকি।
০৪. রুকাস
আমার মা বেশ খাটাখাটুনি করে তরুণটির জন্যে একটা পোশাক তৈরি করলেন। নীল রঙের একটা ট্রাউজার এবং বেশ কয়েকটি পকেটসহ ঢিলেঢালা একটা কোট। আমার মায়ের নানা ধরনের গুণ রয়েছে, কিন্তু পোশাক তৈরি তার মাঝে একটি নয়। তরুণটি সেটা বুঝতে পেরেছে মনে হল না, কারণ পোশাকটা চেষ্টা-চরিত্র করে তাকে পরিয়ে দেবার পর প্রথমবার তার মুখে একটি অভিব্যক্তি দেখা গেল। সে আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে দিল। মা উত্তেজিত হয়ে আমাকে বললেন, দেখলি? দেখলি? কত পছন্দ করল পোশাকটা।