মা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, কী আছে ঐ ঘরে ইলি?
ইলি ভাঙা গলায় বলল, আমি জানি না। খবর পেয়েছিলাম একটা ওষুধের বিক্রিয়ায় ট্রন শিশুদের হৃৎপিণ্ডে কী একটা সমস্যা হচ্ছে। মনে হয়—
কি?
মনে হয় বাচ্চাদের বুক কেটে হৃৎপিণ্ড বের করে নিয়ে গেছে।
আমার মা মুখ ঢেকে বসে পড়লেন। আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। দুঃখ-কষ্ট-বেদনা কিছুই আর আমাকে স্পর্শ করছে না–কিছুই না।
০৩. ঝড়ের রাত
ট্রনেদের আক্রমণের পর তিন মাস কেটে গেছে, সেই ভয়ংকর বিভীষিকার স্মৃতির উপর সময়ের প্রলেপ পড়তে শুরু করেছে। তবে সবার জন্যে নয়। কয়েকটি মা সেই ঘটনার পরপরই সমুদ্রের পানিতে আত্মাহুতি দিয়েছে, তাদের শিশুপুত্র-কন্যাদের পরিণতিটুকু কিছুতেই তারা ভুলতে পারে নি। কয়েকজন মা এবং বাবার খানিকটা করে মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষণ দেখা দিয়েছে। যাদের ধরে নিয়ে গেছে, তাদের প্রিয়জনের মানসিক অবস্থা সম্ভবত আর কখনোই স্বাভাবিক হবে না। তাদের বেশির ভাগই প্রায় সর্বক্ষণ একটি গভীর যন্ত্রণার মাঝে সময় কাটায়।
অন্যের মোটামুটি সামলে নিয়েছে। মানুষের সহ্য করার ক্ষমতার নিশ্চয়ই কোনো সীমা নেই, বিশেষ করে দুঃখী মানুষের। আর আমাদের মতো দুঃখী মানুষ আর কে হতে পারে?
আমার মা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের কাজটি ছেড়ে দিয়েছেন। ট্রনেদের আক্রমণে। সেটিতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। সারতে সময় নেবে। ট্রনদের আক্রমণে অনেক শিশু অনাথ হয়েছে, মা তাদের জন্যে একটা অনাথাশ্রম খুলেছেন। আমি খামারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাকে সেখানে সাহায্য করি।
সেদিন ভোরবেলা থেকেই আকাশ মেঘে ঢাকা। বেলা বাড়ার সাথে সাথে মেঘ কেটে পরিষ্কার না হয়ে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হল, তার সাথে ঝড়ো হাওয়া। মা বাইরে তাকিয়ে বললেন, কুনিল, বৃষ্টির ধরনটা ভালো লাগছে না। আবহাওয়ার বিজ্ঞপ্তিটা কি?
আমাদের সত্যিকার কোনো রেডিও টেলিভিশন স্টেশন নেই। জরুরি প্রয়োজনে বিজ্ঞপ্তি দেয়ার জন্যে শর্ট ওয়েভে কিছু ভিডিও সিগনাল পাঠানো হয়। আলাদা করে টেলিভিশন কারো নেই, কম্পিউটারের মনিটরে ভিডিও সিগনালটি দেখতে হয়। আমি দেখার চেষ্টা করলাম, আবহাওয়া খারাপ বলে ভিডিও সিগনালটিও খুব খারাপ। তবু বুঝতে পারলাম সমুদ্রে একটা নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছে। সেটা ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে আমাদের এলাকায় আসতে পারে। আমি মাকে খবরটা জানালাম। মা চিন্তিত মুখে বললেন, বাচ্চাদের তাহলে সরিয়ে ফেলা দরকার।
কোথায় সরাবে মা?
আরো ভেতরে। স্কুলঘরটা যথেষ্ট উঁচু নয়, জলোচ্ছ্বাস হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। একটা উঁচু জায়গায় রাত কাটানো দরকার।
মা একটি রেনকোট পরে বাইরে যাবার জন্যে প্রস্তুত হলেন। আমি বললাম, দাঁড়াও মা, আমিও যাই তোমার সাথে।
যাবি? চল। মা সহজেই রাজি হয়ে গেলেন। এই ঝড়ো হাওয়ার মাঝে উন্মুক্ত সমুদ্রের ধার ঘেঁষে একা একা যেতে নিশ্চয়ই মায়ের একটু ভয় ভয় করছিল। আমার মা খুব সাহসী মহিলা, প্রয়োজন হলে খেপা সিংহীকেও খালিহাতে জাপটে ধরবেন, কিন্তু ঝড়-বৃষ্টিকে খুব ভয় পান। আমার ঠিক উল্টো। ঝড়-বৃষ্টি আমার অসম্ভব ভালো লাগে। প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে যখন সমুদ্র উত্তাল হয়ে ওঠে, আমি আমার রক্তের মাঝে একধরনের উন্মুক্ত আনন্দের ডাক শুনতে পাই।
সমুদ্রের তীর ঘেঁষে আমরা হেঁটে যাই। আকাশে কেমন একটা লালচে রং। সমুদ্র উত্তাল হয়ে আছে, বড় বড় ঢেউ তীরে এসে আছড়ে পড়ছে। ঝড়োহাওয়া আমাদের উড়িয়ে নিতে চায়। আমরা যখন অনাথাশ্রমের স্কুলঘরটিতে পৌঁছেছি, তখুন দু’জনেই শীতে ঠকঠক করে কাঁপছি।
বাচ্চাগুলো আমার মাকে দেখে খুব খুশি হল। মা একটা আগুন তৈরি করে হাতপা সেঁকে একটু গরম হয়ে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন। জনা পঞ্চাশেক বিভিন্ন বয়সী বাচ্চাকে এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মাইল দুয়েক ভেতরে একটা নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর করা খুব সহজ কথা নয়। যখন কাজ শেষ হয়েছে, তখন বেলা পড়ে এসেছে। কয়েকজন স্থানীয় মানুষকে দায়িত্ব দিয়ে মা ফিরে যাবার জন্যে প্রস্তুত হলেন। এক জন বলল, এই ঝড়-বৃষ্টিতে ফিরে যাবেন কি, রাতটা কাটিয়ে যান।
মা বললেন, না গো, ফিরে যাই। নিজের বাড়ি না হলে ঘুম আসতে চায় না।
আমরা যখন পথে নেমেছি তখন ঝড়ের বেগ আরো অনেক বেড়েছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সুচের মতো বিধছে শরীরে। আকাশে কেমন জানি একটা ঘোলাটে লাল রং, সমুদ্রে কালচে অশুভ ছায়া। বড় বড় ঢেউ এসে প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়ছে তীরে। আমি বুকের ভেতর একধরনের উন্মত্ততা অনুভব করি। দুই হাত উপরে তুলে ঝড়ো হাওয়ার সাথে এক পাক নেচে মাকে বললাম, কী সুন্দর ঝড়।
মা গলা উঁচিয়ে বললেন, কি বাজে কথা বলিস! ঝড় আবার সুন্দর হয় কেমন করে?
আমি মায়ের কথায় কান না দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললাম, আয় আয় আয়রে—আরো জোরে আয়।
মা বললেন, চুপ করু–চুপ কর অলক্ষুণে ছেলে!
আমি আবার চিৎকার করে বললাম, ভেঙে ফেল সবকিছু। ধ্বংস করে ফেল পৃথিবী—
মা আমাকে ধমক দিয়ে কী-একটা বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ থেমে গিয়ে অবাক হয়ে বললেন, কে? কে ওটা বসে আছে এই ঝড়-বৃষ্টিতে?
কোথায়?
মা হাত তুলে সমুদ্রতীর দেখালেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, সত্যিই তাই। সমুদ্রের তীরে বালুবেলায় গুটিসুটি মেরে কে যেন বসে আছে। এত দূর থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু মনে হচ্ছে লোকটির গায়ে কোনো কাপড় নেই। সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ একেক বার খুব কাছে এসে আছড়ে পড়ছে। ঝড়ের বেগ আরো বাড়লে লোকটিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে উত্তাল তরঙ্গ। মা বললেন, ডাক দেখি লোকটাকে।