ট্রন মেয়েটি এক হাতে তার অস্ত্রটি লাবানার দিকে তাক করে গুলি করল আশ্চর্য দক্ষতায়। শিস দেয়ার মতো একটা শব্দ হল, আর লাবানা ছিটকে পড়ল বেলাভূমিতে। টুকটুকে লাল রক্তে ভিজে গেল খানিকটা মাটি।
আমি এর আগে কখনো হত্যাকাণ্ড দেখি নি, গা গুলিয়ে বমি এসে গেল হঠাৎ। লাবানার দেহ ছটফট করছে, তার মাঝে দেহরক্ষী রবোট এসে এক হ্যাচকা টানে ইলোনাকে টেনে সরিয়ে নিল। চিৎকার করে কাঁদল ইলোনা, আম্মু আম্মু গো–
আমি আর সহ্য করতে পারলাম না, চোখ বন্ধ করে ফেললাম তাড়াতাড়ি। মাকে শক্ত করে ধরে রেখেছি আমি, মা কাঁপছেন থরথর করে, ফিসফিস করে বলছেন, হে ঈশ্বর, পরম সৃষ্টিকর্তা, দয়া কর দয়া কর—রক্ষা কর এই নৃশংস পশুদের থেকে।
আমি ভেবেছিলাম জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাব আমি। কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই কেমন জানি বোধশক্তিহীন হয়ে গেলাম। নিষ্ঠুরতা আর হত্যাকাণ্ড দেখে কেমন জানি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। চোখের পলক না ফেলে দেখলাম কী অবলীলায় ট্রন নারী-পুরুষেরা মানুষ হত্যা করে, দেহরক্ষী রবোটেরা কোনো শিশুকে সরিয়ে নেবার সময় তাদের বাবা-মা যদি এতটুকু বাধাও দিয়েছে, সাথে সাথে হত্যা করেছে তাদের।
সব শিশুদের সারি বেঁধে দাঁড় করানো হয়েছে। এক জন এক জন করে পরীক্ষা করছে ট্রন মানুষেরা তাদের বিচিত্র যন্ত্র দিয়ে। তারপর পাশের ঘরগুলোতে পাঠিয়ে দিচ্ছে, সেখানে কী করছে তাদের? রক্ত-শীতল-করা স্বরে আর্তনাদ করছে কেন শিশুগুলো?
ঘরগুলোর ভেতর থেকে সাহায্যকারী রবোটেরা মাঝারি আকারের কিছু বাক্স মহাকাশযানে তুলতে থাকে। কী আছে ঐ বাক্সগুলোতে?
আমরা কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়েছিলাম জানি না। একসময় লক্ষ করি, ট্রনেদের একটা দল আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কিছু পুরুষ এবং কিছু রমণী, আলগোছে একটা অস্ত্র ধরে রেখেছে হাতে, হাসতে হাসতে কথা বলছে তারা। আমাদের কাছাকাছি এসে আবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকায়। কী খুঁজছে, কাকে খুঁজছে কে জানে। মা ফিসফিস করে বললেন, সুন্দরী মেয়ে খুঁজছে এখন।
সত্যিই তাই। আবিনাকে ধরে নিয়ে গেল, দুরিণের বড় মেয়েটিকে ধরে নিয়ে গেল, শুকে ধরে নিয়ে গেল। শুধু সুন্দরী মেয়ে নয়, সুদর্শন পুরুষদেরও ধরে নিয়ে গেল ট্রনের। ক্রিকি বাধা দেয়ার চেষ্টা করছিল, সাথে সাথে গুলি করে মেরে ফেলল তাকে। খাঁচার মতো কিছু জিনিস নামিয়েছিল, এখন বুঝতে পারলাম কেন। মানুষকে যখন পশুর মতন খাচায় ভরে নেয়া হয়, তার থেকে হৃদয়হীন করুণ কোনো দৃশ্য হতে পারে না। খাঁচারশিকগুলো ধরে রেখে পাথরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল আবিনা। দাঁড়িয়ে রইল দুরিণের বড় মেয়েটি। দাঁড়িয়ে রইল শু। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম আবার, শুনতে পেলাম মা বলছেন ফিসফিস করে, শক্তি দাও হে সৃষ্টিকর্তা, শক্তি পাও, শক্তি–মহাকাশযানে সবকিছু তুলে নেয়া হয়েছে।
মায়ের কথা শেষ হবার আগেই গুলি শুরু হল। মাথা নিচু করে শুয়ে পড়ার প্রবল ইচ্ছে দমন করে আমি চোখ বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে, মানুষের আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে আসে। আমি তার মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। মৃত্যু আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আমি তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, ইচ্ছে করলেই সে আমাকে স্পর্শ করতে পারে। সে কি আমাকে স্পর্শ করবে? আলিঙ্গন করবে?
হঠাৎ মনে হল কিছু আসেযায় না। আমি বেঁচে থাকি বা মরে যাই কিছুতেই কিছু আসে-যায় না। আমি চোখ খুলে তাকালাম। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে আগুনের ফুলকির মতো বুলেট ছুটে আসছে আমাদের দিকে। যারা গুলি করছে তাদের মুখের দিকে তাকালাম। তাদের চোখে কৌতুক। তাদের মুখে হাসি। আমি অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। মা সত্যিই বলেছেন। এটি একটি খেলা। অনুসন্ধানকারী রবোটগুলো উঠে গেছে তাদের বেঢপ জাহাজের মতো দেখতে প্লেনটিতে। অল্প কয়জন ট্রন দাঁড়িয়ে আছে নিচে। হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তাক করে রেখেছে আমাদের দিকে। মা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বললেন, যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে গুলি করবে আমাদের, মেরে ফেলবে যতজনকে সম্ভব।
আমার হাতে একটা চাপ দিয়ে আবার বললেন, ভয় পাস নে বাবা, মৃত্যু একবারই আসে।
আমি ভয় পাচ্ছি না মা।
যখন গুলি করা শুরু করবে তখন খবরদার মাথা নিচু করবি না, উবু হয়ে বসে যাবি না, হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবি না—
কেন মা?
যারা মাথা নিচু করে বা শুয়ে পড়ে, তাদের ট্রনেরা গুলি করে মেরে ফেলে সবার আগে।
কেন মা?
জানি না। মনে হয় এটা তাদের একটা খেলা। শেষ মহাকাশযানটি আকাশে উঠে যাবার পরও সবাই দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। ইলি একটু এগিয়ে আসে, একটা বড় পাথরের উপর দাঁড়িয়ে ভাঙা গলায় বলল, যারা বেঁচে আছ তারা শোন, ঐ ঘরগুলোতে কেউ যেন না যায়–
একটি মা পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছিল, তাকে শক্ত করে ধরে ফেলল দু’জন।
আমার মা এগিয়ে গেলেন ইলির দিকে। ইলি উদ্ভ্রান্তের মতো তাকাল মায়ের দিকে। দেখে মনে হচ্ছিল সে চিনতে পারছে না মা’কে। এক জন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। ইলি ভাঙা গলায় বলল, আবার কি দাঁড়াতে পারব আমরা? পারব?
মা মাথা নাড়লেন, পারতে হবে ইলি।
ভয়ংকর একটা আর্তচিৎকার শোনা গেল। হঠাৎ একটি মা ছুটে ঢুকে পড়েছে ঐ ঘরটিতে। কিছু একটা দেখেছে সেখানে। সবাই ছুটে যাচ্ছে এখন।