মায়ের গলার স্বর কেঁপে উঠল হঠাৎ, ভাঙা গলায় বললেন, কাল যদি তুই মরে যাস, আমায় ক্ষমা করে দিস বাবা এমন একটা পৃথিবীতে তাকে জন্ম দেয়ার জন্যে। আমায় ক্ষমা করে দিস।
আবার ভয়ংকর করুণ রক্ত-শীতল-করা শঙ্খের ধ্বনি ভেসে এল দূর থেকে।
অন্ধকার ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসছে। সমুদ্রের ঠাণ্ডা বাতাস বইছে হুঁ হুঁ করে, তার মাঝে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। ছোট বাচ্চাদের মায়েরা গরম কাপড়ে জড়িয়ে দিয়েছে। ভোররাতে ঘুম ভাঙিয়ে তুলে আনার জন্যে কেউ কেউ মৃদু আপত্তি করছে, কিন্তু সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই এখন। আমি মায়ের হাত ধরে একটা ঝাউগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। সবাই বের হয়ে এসেছে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পালিয়ে যাবার কোনো স্থান নেই এদের হাত থেকে। ইলি নতুন একটা জ্যামার তৈরি করার চেষ্টা করছে, যেটা দিয়ে অনুসন্ধানী রবোটদের বিভ্রান্ত করে দেয়া। যাবে, কিন্তু সেটা তৈরি শেষ হয় নি। সব যন্ত্রপাতি জোগাড় করতে আরো বছরখানেক লেগে যাবার কথা, সেটা তৈরি করতে পারলে এক জন দু’জন খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে পাহাড়ে লুকিয়ে ফেলা যেত। কিন্তু সেটা এখনো তৈরি হয় নি, আগেই ট্রনেরা চলে এসেছে। পুরোপুরি এখন আমাদের ভাগ্যের উপর নির্ভর করে থাকতে হবে। কে জানে। কী করবে ট্রনেরা! কতজন মানুষকে মারবে, কী ভাবে মারবে।
সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হয় যেন অদৃশ্য কোনো বক্তা কথা বলছে আর সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে তার কথা। হালকা কুয়াশায় মূর্তির মতো স্থির হয়ে আছে সবাই। শিশুগুলোও জানি কেমন করে বুঝে গেছে ভয়ংকর। একটা ব্যাপার ঘটবে কিছুক্ষণের মাঝে। কেউ আর কাঁদছে না, বিরক্ত করছে না, চুপ করে অপেক্ষা করছে মায়ের হাত ধরে।
প্রথমে এল একটা ছোট প্লেন। খুব নিচু দিয়ে উড়ে গেল সেটি, ইতস্তত কয়েকটি বিস্ফোরক ফেলল আশেপাশে। প্রচণ্ড শব্দ করে বিস্ফোরণ হল। আগুনের হলকা উঠে গেল আকাশে। মা ফিসফিস করে বললেন, ভয় দেখাচ্ছে আমাদের। সব সময় ভয় দেখায় প্রথমে।
এরপর মাঝারি আকারের একধরনের প্লেন উড়ে এল, দেখে মোটেও প্লেন মনে হয় না, মনে হয় কোনো বড় জাহাজ ভুল করে আকাশে উঠে গেছে। এই প্লেনগুলো থেকে প্যারাসুটে করে ছোট ছোট রবোট নামতে থাকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে। মা আবার ফিসফিস করে বললেন, অনুসন্ধানী রবোর্ট।
রবোটগুলো আমাদের সবাইকে ঘিরে নেয় প্রথমে, তারপর আরো কাছাকাছি একত্র করে আনে। কেউ কেউ নিশ্চয়ই ভয়ে পাহাড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল, কারণ ইতস্তুত গুলির আওয়াজ আর মানুষের আর্তনাদ শোনা যেতে থাকে কিছুক্ষণ। একসময়ে আবার নীরব হয়ে যায় চারদিক। যারা পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল, সবাইকে নিশ্চয়ই পেয়ে গেছে অনুসন্ধানী রবোর্ট।
ট্রনেরা এল ছোট ছোট দলে, চমৎকার একধরনের মহাকাশযানে করে। ধবধবে সাদা মহাকাশযান, দু’পাশে ছোট দুটি পাখা, পিছনে শক্তিশালী ইঞ্জিন। সমুদ্রের বালুতটে খুব সহজে নেমে স্থির হয়ে যায় মহাকাশযানগুলো। দরজা খুলে নেমে আসে ট্রন নারী-পুরুষ। আমি আগে কখনো ট্রন দেখি নি, ভেবেছিলাম তাদের চেহারা হবে ভয়ংকর নিষ্ঠুর। কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখলাম তারা দেখতে ঠিক আমাদেরই মতো, হয়তো গায়ের রং একটু স্বচ্ছ, চোখের রং গাঢ় নীল, নাকটা একটু বেশি ঋজু, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। ট্রন নারী-পুরুষেরা নেমে সমুদ্রের পানিতে খেলা করতে থাকে, বালুতট থেকে ঝিনুক কুড়ায়, হালকা স্বরে হাসি-তামাশা করে পানীয়তে চুমুক দেয়। কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। দেখে একটি বারও মনে হয় না কোনো নৃশংস অভিযানে এসেছে এই হাসিখুশি মানুষগুলো।
সাহায্যকারী রবোট এসেছে বেশ কয়টি। সেগুলো এর মাঝে কয়টি বড় বড় টেবিল পেতেছে সমুদ্রতটে। কিছু যন্ত্রপাতি দাঁড় করিয়েছে আশেপাশে, আশ্চর্য সুন্দর সেই সব যন্ত্রপাতি, কী কাজে আসে কে জানে! ছোট ছোট উজ্জ্বল রঙের কয়েকটা ঘর তৈরি করল কিছু টেবিলকে ঘিরে। কিছু বিচিত্র ধরনের বাক্স নামাল মহাকাশযান থেকে। উজ্জ্বল কিছু খাঁচা। দেখে মনে হতে থাকে সমুদ্রতীরে আজ বুঝি মেলা বসেছে।
রবোটগুলো আশ্চর্য দক্ষতায় তাদের কাজ শেষ করে একপাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে যায়। ট্রনগুলো তখন কাজ শুরু করে নিজেদের। কয়েকজন ধবধবে সাদা পোশাক পরে ছোট ছোট্ট ঘরগুলোতে ঢুকে পড়ে। অন্যেরা টেবিলের পাশে বসে যন্ত্রপাতি নিয়ে। কয়েকজন হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। তাদের পিছে পিছে থাকে দেহরক্ষী রবোট।
একটি ট্রন মেয়ে এগিয়ে আসে আমাদের দিকে। হেঁটে হেঁটে আমাদের খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। এত কাছে যে আমি তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই। একমাথা কালো চুল সমুদ্রের বাতাসে উড়ছে। স্বচ্ছ কোমল গায়ের রং, গাঢ় নীল চোখ, লাল ঠোঁট। কী চমৎকার শরীর মেয়েটির। নিও পলিমারের পোশাকে ঢাকা সুঠাম দেহ। ভরাট বুক নিঃশ্বাসের সাথে উঠছে-নামছে। মেয়েটি আমাদের উপর চোখ বুলিয়ে নেয়—তার দৃষ্টি স্থির হয় কিছু শিশুর উপর। আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয় তাদের। কিছু একটা বলে ট্রন ভাষায়, মনে হয় সুরেলা গলায় গান গাইছে কেউ।
দেহরক্ষী রবোটগুলো এবারে এগিয়ে আসে শিশুদের দিকে, হাতের অস্ত্র তাক করে।
আমাদের ঠিক পাশেই ছিল লাবানা তার তিন বছরের মেয়ে ইলোনাকে নিয়ে। হঠাৎ সে ইলোনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলে, না-না—