ইলি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কুনিল, তুমি খাবে একটু গরম পানীয়?
আমি মাথা নাড়লাম। ইলি চমৎকার একধরনের পানীয় তৈরি করে, খানিকটা ঝাঁঝালো খানিকটা মিষ্টি উষ্ণ একধরনের তরল। একবারে খাওয়া যায় না, আস্তে আস্তে খেতে হয়। খাওয়ার পর সারা শরীরে একধরনের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে, কেমন জানি সতেজ মনে হতে থাকে নিজেকে। পানীয়টি ছোটদের খাওয়ার কথা নয়—ইলি তবুও মাঝে মাঝে আমাকে খেতে দেয়।
ইলির রান্নাঘরে খাবার টেবিল ঘিরে বসে সবাই কথা বলতে থাকে। বেশির ভাগই নানা ধরনের সমস্যার কথা, কেমন করে সমাধান করা যায় তার আলোচনা। আমি এক কোনায় বসে বসে শুনি। খুব ভালো লাগে শুনতে। ভারি ইচ্ছে করে আমার বড় হতে, তাহলে আমিও তাদের মতো কঠিন কঠিন সব সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারব।
পানীয়টি শেষ করে আমি উঠে পড়ি। ইলি আবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, আগের বইটি শেষ হয়েছে?
একটু বাকি আছে। এক্সপেরিমেন্টের অংশটা করতে পারলাম না।
ইলি মাথা নাড়ল, পরের বার দেখি জোগাড় করা যায় কী না।
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, ইলি, মানব জন্মরহস্য বইটা আমাকে আবার দেবে?
ইলি চোখ মটকে বলল, কেন, আবার কেন?
কিরীণা পড়তে চেয়েছিল—বলতে গিয়ে আমার কান লাল হয়ে ওঠে।
ইলি শেলফ থেকে একটা ছোট ক্রিস্টাল বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, এই নাও।
আমি পকেটে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। বাইরে অন্ধকার হয়ে এসেছে। সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে, মনে হয় কোনো এক জন মানুষ কাকুতি-মিনতি করে কিছু একটা চাইছে। পাথরের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে আমি বাসায় ফিরে যেতে থাকি। আমার মা এতক্ষণে নিশ্চয়ই ফিরে এসেছেন। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে কাজ করেন মা, কন্ট্রোল রুমে বসে বসে তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করেন সবকিছু। ছোট ছোট সুইচ রয়েছে, ছোট ছোট হাতল, মা এবং আরো কয়েকজন মহিলা সেগুলো আলতোভাবে স্পর্শ করে রাখে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে হাত দিয়ে পুরো রি-অ্যাক্টরটিকে বন্ধ করে দিতে হবে। একটু ভুল হলে পুরো রি-অ্যাক্টর আর আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে বাতাসে।
কোনোভাবে যদি একটা ভালো কম্পিউটার চুরি করে আনা যেত ট্রনদের থেকে?
কিরীণার বাসার কাছ দিয়ে যাবার সময় আমি সবসময় ঝাউগাছের নিচে একবার দাঁড়াই। সমুদ্রের বাতাসে ঝাউগাছের পাতা শিরশির করে কাঁপতে থাকে, কেমন যেন কান্নার মতো একটা শব্দ হয়। অকারণে কেমন জানি মন খারাপ হয়ে যায়। আমি চুপচাপ তাকিয়ে থাকি। রান্নাঘরে চুলোর সামনে দাঁড়িয়ে কিরীণা রান্না করছে। আগুনের লাল আভা পড়েছে মুখে, নিচের ঠোঁট কামড়ে বড় একটা পাত্রে ফুটন্তু কী একটা ঢেলে দিল, এক ঝলক বাষ্প বের হয়ে এল সাথে সাথে হাতের বড় চামচটা নিয়ে সে নাড়তে থাকে দ্রুত।
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি। আমার বড় ভালো লাগে কিরীণাকে দেখতে।
০২. ট্রন
কিরীণা মাথার লাল স্কার্ফটি খুলে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে সমুদ্রের দিকে ছুটে গেল। আকাশে ঘন কালো মেঘ, সমুদ্র ফুসে উঠেছে একধরনের উন্মত্ততায়। আমি ডাকলাম, কিরীণা—
কিরীণা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল তারপর দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াল উপাসনার ভঙ্গিতে। উত্তাল সমুদ্র থেকে ভয়ংকর একটি ঢেউ ছুটে আসছে কিরীণার দিকে। আমি আবার ডাকলাম, কিরীণা—
ঢেউটি এসে আঘাত করল কিরীণাকে। তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল উত্তাল সমুদ্রে। কিরীণা আমার দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠল। আমি ছুটে গেলাম, কিন্তু কিরীণা ভেসে গেল আরো গভীরে।
কিরীণ চিৎকার করে ডাকল আমাকে। তার গলা থেকে মানুষের কণ্ঠস্বর বের না হয়ে শঙ্খের মতো শব্দ হল। গাঢ় ভরাট একটি অতিমানবিক ধ্বনি, আমার সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। আমি চমকে ঘুম ভেঙে জেগে উঠি হঠাৎ। সারা শরীর ভিজে গেছে ঘামে, বুকের মাঝে ঢাকের মতো শব্দ করছে হৃৎপিণ্ড। মনে হচ্ছে বুক ফেটে বের হয়ে আসবে হঠাৎ
শঙ্খের মতো শব্দটি শুনতে পেলাম আবার। ভয়ংকর করুণ একটি শব্দ। মনে হল পৃথিবীর সব মানুষ করুণ স্বরে আর্তনাদ করছে সৃষ্টিজগতের কাছে। কিসের শব্দ এটি? আমি পায়ে পায়ে বিছানা থেকে নেমে আসি। বাইরের ঘরের জানালা খোলা, মা দাঁড়িয়ে আছেন খোলা জানালার সামনে। চুল উড়ছে সমুদ্রের বাতাসে, দুই হাতে জানালার পাল্লা ধরে অশরীরী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন মা। কেন জানি আমার বুক কেঁপে উঠল, আমি ভয় পাওয়া গলায় ডাকলাম, মা।
মা খুব ধীরে ধীরে ঘুরে তাকালেন আমার দিকে। জ্যোৎস্নার নীল আলোতে মাকে মনে হচ্ছে অন্য কোনো জগতের প্রাণী। ঠিক তখন আবার সেই শঙ্খের আওয়াজ ভেসে এল দূর থেকে। রক্ত-শীতলকরা ভয়ংকর করুণ একটি ধ্বনি।
আমি আবার ডাকলাম, মা—
কি বাবা?
ওটা কিসের শব্দ?
মা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সাইরেন।
সাইরেন কেন বাজে মা?
মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে এগিয়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে, তারপর বললেন, আজ আমাদের খুব দুঃখের দিন বাবা। খুব দুঃখের দিন।
কেন মা?
ঐ যে সাইরেনের আওয়াজ হচ্ছে, তার অর্থ হল, বিশাল এক ট্রন বাহিনী আসছে আমাদের কাছে।
থরথর করে কেঁপে উঠলাম আমি আতঙ্কে। মা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বললেন, বাবা আমার, সোনা আমার, কোনোদিন তোকে আমি বলি নি আমি তোকে কত ভালবাসি। কাল যদি আমি মরে যাই, তুই জেনে রাখিস, তুই ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার আর কোনো আপনজন নেই। পৃথিবীর সব ভালবাসাকে একত্র করলে যত ভালবাসা হয়, আমি তোকে তার থেকেও বেশি ভালবাসি। আর—আর—