মা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় আসছে?
সমুদ্রতীরে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার না রক্ষাব্যুহ ছিল?
হ্যাঁ, আছে। এখনো আছে।
কেন সেগুলো ব্যবহার করছ না?
পারছি না। ক্লডিয়ানের দল জাম করে দিয়েছে।
তোমরা কোনো বাধা দিচ্ছ না? আঘাত করছ না?
টুবু আস্তে আস্তে বলল, রুকাস চাইছে না।
আমি রুকাসের দিকে তাকালাম, রুকাস?
রুকাস শান্ত মুখে বসে ছিল, বলল, ‘আজ থেকে দু’হাজার বছর পরের অস্ত্রের কথা। তুমি জান না। ক্লডিয়ানের সাথে যদি এখানে সন্মুখযুদ্ধ শুরু করা হয়, তোমাদের শহর, নগর সব ধ্বংস হয়ে যাবে। তা ছাড়া–
তা ছাড়া কি?
যে সত্যটির জন্যে ক্লডিয়ান আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল, সেটি আমার লোকজনের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আমার জন্যে একটি মানুষের জন্যে আমি এতবড় বিপর্যয় ঘটতে দিতে পারি না।
তুমি কি ভবিষ্যতে চলে যেতে পার না?
এখন আর পারি না। তা ছাড়া—
তা ছাড়া কি?
ক্লডিয়ানের দল যদি চায়, ভবিষ্যতে গিয়েও আমাকে খুঁজে বের করবে। তার প্রয়োজন নেই।
রুকাস উঠে দাঁড়ায়। বলে, চল টুবু।
কোথায় যাচ্ছ?
সমুদ্রতীরে। ক্লডিয়ানের সাথে দেখা করতে।
টুবুর ভাবলেশহীন ধাতব মুখে অনুভুতির কোনো চিহ্ন নেই। সে ধীরে ধীরে নিজের বুকের একটা অংশ খুলে একটি অস্ত্র বের করে দেয়, প্রাচীনকালের অস্ত্রের মতো। ছোট একটি হাতলে ধরে ট্রিগার টানতে হয়। সামনে ছোট নল, ভেতর থেকে বুলেট বের হয়ে আসে।
টুবু বলল, এটি বিংশ শতাব্দীর অস্ত্র। পুরোটা যান্ত্রিক। এর মাঝে কোনো ইলেকট্রনিক নিয়ন্ত্রণ নেই। কেউ এটাকে জ্যাম করতে পারবে না। ভেতরের বুলেটগুলি অনেক শক্তিশালী, বায়োবটের যান্ত্রিক দেহ ভেদ করে ভেতরে যেতে পারবে।
কি নাম এটার?
রিভলভার। কাছে থেকে গুলি করতে হয়। আর শোন, আমি নিশ্চিত, ক্লডিয়ানেরা এই এলাকার পুরো ইলেকট্রনিক সার্কিট জ্যাম করে দেবে। আমি সম্ভবত পুরোপুরি বিকল হয়ে যাব। যদি তোমার সাথে আমি আর কথা বলতে না পারি, তাহলে এই হবে আমাদের বিদায় সম্ভাষণ।
রুকাস এগিয়ে এসে টবুকে গভীর ভালবাসায় আলিঙ্গন করে, আমি দেখতে পাই রুকাসের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে। রুকাস ইবুকে ছেড়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে, আমাকে আলিঙ্গন করে বলে, কুনিল, আমার যদি উপায় থাকত আমি তাহলে এখানেই থেকে যেতাম।
আমাকে ছেড়ে দিয়ে কুনিল আমার মায়ের দিকে এগিয়ে যায়। মা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমার প্রথম ছেলেটি খুব অল্পবয়সে মারা গিয়েছিল, তোমাকে দেখে মনে হয়েছিল তুমি বুঝি আমার সেই ছেলে, ফিরে এসেছ।
রুকাস বলল, আপনি আমার জন্মদাত্রী মা নন, কিন্তু আপনি আমার মা। আপনাকে দেখে আমি বুঝেছি, আমি ভালবাসার কত বড় কাঙাল।
মা রুকাসকে ছেড়ে দিলেন। রুকাস মাথা নিচু করে ঘুরে খোলা দরজা দিয়ে অন্ধকারে বের হয়ে গেল। টুলু ঘুরে আমাদের দিকে তাকাল, কলল, বিদায়। তারপর সেও রুকাসের পিছু পিছু বের হয়ে গেল।
আমি মায়ের হাত ধরে খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম রুকাস আর টুবু হেঁটে হেটে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।
রাতের আকাশ বিন্দু বিন্দু আলোতে ভরে যাচ্ছে, আগে কখনো দেখি নি, কিন্তু তবু আমার বুঝতে বাকি থাকে না, বায়োটের বিশাল বাহিনী নেমে আসছে সমুদ্রতীরে।
রাত্রিটা ছিল আশ্চর্য রকম নীরব। রাতজাগা একটা পাখি হঠাৎ করুণ স্বরে ডেকে ডেকে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল, পাখির করুণ চিৎকারে আমার বুকটা হঠাৎ হা হা করে ওঠে। ঠিক তখন আমার কিরীণার কথা মনে পড়ল। কিরীণা কি তার অলৌকিক কণ্ঠস্বরে গাঢ় বিষাদের একটা সুরে ক্লডিয়ানকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে মা? আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, মা, আমাকে যেতে হবে।
কোথায়?
কিরীণার কাছে।
কেন?
পরে বলব মা তোমাকে, এখন সময় নেই।
মা বাধা দেবার আগে আমি ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। কিরীণাদের বাসা খুব কাছে, সে ঘুমায় বাইরের দিকে একটি ঘরে। আমি জানালায় শব্দ করে চাপা স্বরে ডেকে বললাম, কিরীণা।
কিরীণার ঘুম খুব হালকা, সে সাথে সাথে উঠে বসে ভয়-পাওয়া গলায় বলল, কে?
আমি কুনিল।
কী হয়েছে কুনিল?
রুকাস চলে গেছে।
কোথায়?
সমুদ্রতীরে, ক্লডিয়ানের সাথে মুখোমুখি হতে।
সর্বনাশ!
কিরীণা।
কি?
তুমি কি যাবে রুকাসকে বাঁচাতে?
আমি। কিরীণা অবাক হয়ে বলল, আমি?
হ্যাঁ।
আমি কেমন করে রুকাসকে বাঁচাব?
বলব আমি তোমাকে, তুমি বের হয়ে এস। দেরি কোরো না, সময় নেই আমাদের মোটেই।
কিছুক্ষণেই রাতের অন্ধকারে আমি কিরীণার হাত ধরে ছুটে যেতে থাকি।
আকাশে বড় একটা চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের আলোতে আমি দেখতে পাই রুকাস সমুদ্রের বালুবেলায় দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে তার চুল উড়ছে, কাপড় উড়ছে। আশেপাশে কোথাও টুকু নেই। সত্যি কি তার ইলেকট্রনিক সার্কিট জ্যাম করে বিকল করে দিয়েছে?
আমি কিরীণাকে নিয়ে রুকাসের কাছাকাছি একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে গেলাম।
বিশাল বায়োবট-বাহিনী ধীরে ধীরে নেমে আসছে। অন্ধকারে জোনাকি পোকার মতো জ্বলছে তাদের আলো। মাটির কাছাকাছি এসে অতিকায় মহাকাশযানগুলো স্থির হয়ে গেল। গোল গোল দরজা খুলে বায়োবটেরা নামতে থাকে অস্ত্র হাতে। ধীরে ধীরে তারা ঘিরে ফেলছে রুকাসকে। ইচ্ছে করলেই তারা ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে তাকে। কিন্তু তারা রুকাসকে আঘাত করল না।
আমি দেখতে পেলাম এক জন দীর্ঘ পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে রুকাসের দিকে। আমি চিনতে পারলাম তাকে, ক্লডিয়ান।