আমার মুখ থেকে পুরোটা শুনে রুকাস অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। মা বললেন, এটা কেমন করে হয় যে তুই এতদিন ওর সাথে থেকে এলি, আর কিরীণা জানতেও পারল না, তোর মনে হল তুই সেখানেই আছিস?
টুবু বলল, ওকে স্থির সময়ের ক্ষেত্রে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে সময় সামনেও প্রবাহিত হয় না, পিছনেও হয় না। বায়োবটরা এ ব্যাপারে মানুষের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে আছে।
মা বললেন, এই সন্ধেবেলা পাহাড়ের নিচে যাওয়ার দরকার কি ছিল? সাপখোপ কত কী আছে সেখানে!
কিরীণা বলল, অনেক যখন রাগ হল ক্লডিয়ান, তখন হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল কেন সে?
টুকু বলল, সেটা তো জানি না।
রুকাস বলল, আমার মনে হয় কি জান?
কি?
আমরা বায়োবটদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতাটি খুঁজে পেয়েছি।
কী?
বায়োবটেরা যান্ত্রিক উৎকর্ষের চরমে পৌঁছে গেছে। তাদের দৈনন্দিন জীবন অত্যন্ত নিখুঁত। সেখানে কোনো ভুলত্রুটি নেই। সেটি নির্ভুল। সেখানে অনুভূতির স্থান নেই। সাধারণ মানুষেরা যখন তীব্র আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে যায় তখনো বায়োবটেরা থাকে আশ্চর্য ধীরস্থির। তাদের মস্তিষ্ক সবসময়েই শান্ত। সেখানে কোনো উচ্ছ্বাস নেই। তাদের যান্ত্রিক শরীর সেই শান্ত মস্তিষ্কের সাথে নির্ভুলভাবে কাজ করে।
রুকাস খানিকক্ষণ নিজের আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু সেই মস্তিষ্ক যদি বিচলিত হয়ে ওঠে, ক্রোধ কিংবা ভালবাসা, আনন্দ কিংবা দুঃখ যাই হোক, সেই আবেগ যখন তীব্র হয়ে ওঠে একসময়, শরীরের যান্ত্রিক যোগাযোগ হঠাৎ করে মস্তিস্কের সাথে আর তাল মিলিয়ে থাকতে পারে না। হঠাৎ করে শরীরের একটি দুটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। তাই ক্লডিয়ান যখন ভয়ঙ্কর রাগে উন্মত্ত হয়ে গিয়েছিল, তখন হঠাৎ হাঁটু ভেঙে পড়ে গিয়েছিল।
কিরীণা জুলজুল চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই কুনিল যখন সংগীতের কথা বলেছিল, ক্লডিয়ান এত আপত্তি করেছিল?
হ্যাঁ। রুকাস মাথা নাড়ে। আমরা জানি বায়োবট-জগতে কোনো সংগীত নেই। বায়োবট-শ্লোগান হচ্ছে, “সংগীত কর্মক্ষমতা ক্ষুন্ন করে। প্রকৃত ব্যাপারটি ভিন্ন, সংগীত আসলে তাদের শরীরের যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের মাঝে আঘাত করে। মানুষের মস্তিষ্ক, তার আবেগের গভীরতা এত বিশাল, পৃথিবীর কোনো যন্ত্র তার সাথে সর্বক্ষণ তাল মিলিয়ে থাকতে পারে না।
ক্লাস খুব শান্ত গলায় বলল, এক জন সাধারণ মানুষ পরিপূর্ণ মানুষ। একটি রবোট পরিপূর্ণ একটি যন্ত্র। এক জন বায়োবট পরিপূর্ণ নয়, সে অসম্পূর্ণ। মানুষের মস্তিস্কে তার রয়ে গেছে মানুষের আবেগ, কিন্তু সেই তীব্র আবেগকে নিয়ন্ত্রণের মতে তার যান্ত্রিক দেহ নেই। পৃথিবীতে যদি কোনো সত্যিকার মানুষ না থাকে, বায়োবটের কোনো ভয় নেই। কিন্তু একটি মানুষও যদি বেঁচে থাকে, তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। তাদের দেখিয়ে দিতে পারে এই ভয়ঙ্কর অসঙ্গতি।
রুকাস উত্তেজিত হয়ে ঘরের মাঝে পায়চারি করতে থাকে। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে, দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ। ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে সে বলল, বায়োবটদের সাথে আমাদের প্রকৃত যুদ্ধ অস্ত্র দিয়ে হবে না, প্রকৃত যুদ্ধ হবে সংগীত দিয়ে, শিল্প দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে তাদের বলতে হবে অসম্পূর্ণ হয়ে থেকো না, পরিপূর্ণ অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাক, পরিপূর্ণ অস্তিত্ব নিয়ে।
রুকাস হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, আমি সব সময় খুব অবাক হয়ে ভাবতাম, পৃথিবীর এত বায়োবটদের সাথে এই ভয়ংকর যুদ্ধে আমি কেমন করে নেতৃত্ব দেব? আমি যোদ্ধা নই, আমি নেতা নই, আমি সাধারণ, খুব সাধারণ এক জন মানুষ। তবে হ্যাঁ, আমার বুকের ভেতরে আমি সবসময় অনুভব করি তীব্র আবেগ। ক্ষুদ্র একটা জিনিসে আমি অভিভূত হয়ে যাই। বায়োবটদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র এটা।
আমি ইতস্তত করে বললাম, রুকাস।
বল।
এই জিনিষটি তুমি হঠাৎ করে বুঝতে পারবে, সে জন্যেই কি বায়োবটেরা তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল?
রুকাস জ্বলজ্বলে চোখে বলল, আমার তাই ধারণা।
তারা তোমাকে হত্যা করতে পারে নি, তুমি এটা ভেবে বের করেছ, তাহলে কি বলতে পারি বায়োবটেরা মানুষের সাথে যুদ্ধে হেরে গেল?
রুকাস কেমন একটি বিচিত্র চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, আমি জানি না কুনিল, কিন্তু আমি তাই প্রার্থনা করি। তাই প্রার্থনা করি।
আমার মা বিড়বিড় করে বললেন, হে ঈশ্বর, হে পরম আত্মা। তুমি রক্ষা কর, মানব জগতকে তুমি রক্ষা কর।
কিরীণা নিচু স্বরে বলল, ককাস।
বল কিরীণা।
তুমি যখন সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের সামনে দাঁড়িয়েছিলে, জলোচ্ছাস থেমে গিয়েছিল। ট্রন মেয়েটি তোমাকে গুলি করে মারতে পারে নি। কুনিলের শরীরের বিস্ফোরক সরিয়ে নেয়া হয়েছে প্রকৃতি সবসময় তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
হ্যাঁ কিরীণা।
বাঁচিয়ে রেখেছে, কারণ তুমি যেন এই সত্যটি বুঝতে পার। বায়োবটদের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পার।
আমার তাই ধারণা।
এখন তুমি সেই সত্যটি জেনে গেছ। তোমার দায়িত্ব তুমি শেষ করেছ।
হ্যাঁ।
প্রকৃতির তোমাকে আর রক্ষা করার প্রয়োজন নেই?
রুকাস খানিকক্ষণ একদৃষ্টে কিরীণার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি জানি না কিরীণা। কিন্তু আমার মনে হয় তোমার ধারণা সত্যি।
ক্লডিয়ান যখন তোমাকে হত্যা করতে আসবে, তোমাকে প্রকৃতি আর রক্ষা করবে না?
রুকাস ফিসফিস করে বলল, মনে হয় না।
কেন জানি হঠাৎ আমার বুক কেঁপে উঠল।
গভীর রাত্রিতে আমার ঘুম ভেঙে গেল, রুকাসের ঘরে টুকু নিচুস্বরে কথা বলছে। রুকাস আর মা চুপচাপ বসে আছে লাল ত্রিমাত্রিক ছবিটি ঘিরে। টুবু বলল, ক্লডিয়ান আসছে তার বিশাল বাহিনী নিয়ে।