তারপর হঠাৎ একদিন আমার ঘুম ভেঙে যায়, আর দেখতে পাই আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে ধাতব একটি মুখ, সবুজ নিস্পলক চোখ। আমি ফিসফিস করে বললাম, কে তুমি, ক্লডিয়ান?
হ্যাঁ।
আমাকে যেতে দেবে?
যখন সময় হবে তখন।
কখন সময় হবে?
আমি এখনো জানি না।
কিন্তু আমি যে আর পারি না।
তুমি কি কিছু চাও?
আমি যেতে চাই।
অন্য কিছু চাও?
এই নৈঃশব্দ আমার কাছে অসহ্য মনে হচ্ছে। কোনো সংগীত কি শুনতে পারি? কোনো মিষ্টি সুর?
সংগীত! ক্লডিয়ান হঠাৎ চমকে উঠল। সংগীত?
হ্যাঁ। কোনো সংগীত।
না। ক্লডিয়ান হঠাৎ চিৎকার করে বলল, না, তুমি কোনো সংগীত শুনতে পাবে না। না। না।
আমি হকচকিয়ে গেলাম, বললাম, কেন নয়?
ক্লডিয়ান আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বলল, ঠিক আছে, আমি তোমাকে যেতে দেব।
সত্যি?
হ্যাঁ।
কখন?
এখনই। যাও, তুমি যাও। রুকাসকে বল আমি তাকে সামনাসামনি দেখতে চাই।
বলব।
যাও।
আমি উঠে দাঁড়ালাম, সাদা কুয়াশার মতো একটি ধোঁয়া আমাকে ঘিরে ফেলতে থাকে, আমার চোখ ভারী হয়ে আসতে থাকে, হঠাৎ শুনতে পাই ক্লডিয়ান বলছে, যাবার আগে আমাকে একটি কথা বলে যাও।
কি?
তুমি কেন কিরীণাকে এত ভালবাস?
আমি জানি না।
জান না?
না।
গভীর ঘুমে আমি অচেতন হয়ে গেলাম। ছাড়াছাড়াভাবে দেখলাম, আমি বিশাল বালুবেলায় ছুটে যাচ্ছি, আমার পিছনে তাড়া করছে হাজার হাজার বুননা কুকুর। আমি চিৎকার করে ছুটছি, চিৎকার করে ছুটছি। হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম আমার হাতের নখ বড় হয়ে যাচ্ছে, মুখ থেকে বের হয়ে আসছে কুৎসিত দাঁত, আমি একটা দানবে পাল্টে যাচ্ছি—ভয়ঙ্কর বীভৎস দানব! বুনো কুকুরের দল থমকে দাঁড়িয়েছে আমাকে দেখে, তারপর প্রাণভয়ে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর চিৎকার করে উঠলাম আমি, সাথে সাথে ঘুম ভেঙে গেল আমার। চোখ খুলে দেখলাম আমি পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছি, আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে কিরীণা, বলছে, কুনিল, কী হল তোমার? কী হল?
আমি কোথায়?
এই তো এখানে।
আমি কেমন করে এলাম?
কেমন করে এলে মানে? কিরীণা অবাক হয়ে বলল, তুমি তো এখানেই ছিলে!
এখানেই ছিলাম! কতক্ষণ থেকে?
সবসময়ই তো এখানে ছিলে।
সবসময়ই।
হ্যাঁ, কথা বলতে বলতে হঠাৎ তুমি চোখ বন্ধ করে পড়ে যাচ্ছিলে।
তারপর?
আমি তোমাকে ধরেছি আর তুমি চোখ মেলে তাকিয়েছ।
আর কিছু হয় নি?
না।
আমি বিভ্রান্তের মতো কিরীণার দিকে তাকালাম। কিরীণা অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে তোমার?
আমাকে ক্লডিয়ান ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
কিরীণা আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। আমি বললাম, সত্যি।
আমি বুঝতে পারি, কিরীণা আমার কথা বিশ্বাস করছে না। কিন্তু সে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ঠিক আছে কুনিল, চল, এখন বাসায় যাবে।
আমি কিরীণার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না?
কিরীণা আমার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না। আমার হঠাৎ কী মনে হল জানি না, বাম হাতটি চোখের সামনে তুলে ধরলাম। হাতের কনুইয়ের কাছে একটা কাটা দাগ। দেখে মনে হয় পুরানো একটা ক্ষত।
আমি অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। কারণ আমার এখানে কোনো ক্ষত চিহ্ন ছিল না। আমি ফিসফিস করে বললাম, এই দেখ–ক্লডিয়ান আমার হাতের মাঝে কেটে কিছু-একটা ঢুকিয়ে দিয়েছে।
কিরীণা বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, আমার এখন রুকাসের কাছে যেতে হবে।
কিরীণা স্থিরদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, না, তুমি রুকাসের কাছে যেতে পারবে না। কিছুতেই যেতে পারবে না।
কিরীণা হঠাৎ শক্ত করে আমার হাত ধরে রাখে।
০৯. মুখোমুখি
টুবু আমাকে টেবিলে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে। বাম হাতটা একপাশে লম্বা করে রেখে সেটিকে শক্ত করে ধরে রেখে ধরালো একটা চাকু দিয়ে পুরানো ক্ষতটা নূতন করে চিড়ে ফেলল। ব্যথা লাগল না মোটেও, কী একটা ইনজেকশান দিয়ে পুরো হাতটা অবশ করে রেখেছে। কাটা অংশ দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে এল, খানিকটা তুলো দিয়ে সেটা চেপে ধরে টুবু হাতের চামড়ার নিচে থেকে পাতলা একটি চাকতির মতো জিনিস বের করে আনে।
আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখে বললাম, কী এটা?
ডি বিস্ফোরক। আমি নিশ্চিত, রুকাসের গলার স্বর প্রোগ্রাম করে রাখা আছে, সেটি শুনতে পারলেই বিস্ফোরণ ঘটবে।
টুকু কিরীণার দিকে তাকিয়ে বলল, কিরীণা, ভবিষ্যতের পৃথিবী আজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে, রুকাসের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে।
কিরীণা লজ্জা পেয়ে একটু হাসল। টুবু বলল, কুনিলকে তুমি রুকাসের কাছে। যেতে না দিয়ে অসম্ভব বুদ্ধির কাজ করেছ।
কিরীণা ইতস্তত করে বলল, আমি জানি না, কেন জানি মনে হল কুনিলকে রুকাসের কাছে যেতে দেয়া যাবে না।
আমি বললাম, এখন তো কোনো ভয় নেই, আমাকে কি উঠতে দেবে টেবিল থেকে?
টুবু আমার উপর ঝুকে পড়ে বলল, এক সেকেণ্ড দাঁড়াও, আমি তোমাকে ভালো করে আরেকবার পরীক্ষা করে নিই।
পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে টুবু আমার বাঁধন খুলে দেয়। আমি টেবিলে বসে বললাম, এই বিস্ফোরকটি কি ফেলে আসবে কোথাও?
হ্যাঁ। ভয়ঙ্কর বিস্ফোরক এটি, খুব সতর্কভাবে ফেলতে হবে। খানিকক্ষণ সময় দাও আমাকে, আমি এটা খুলে বিস্ফোরকটি আলাদা করে ফেলি।
ফেটে যাবে না তো আবার?
উত্তরে টুবু হাসার মতো একধরনের শব্দ করল।
ডিস্ক বিস্ফোরকটি থেকে রুকাসের গলার স্বরের সাথে প্রোগ্রাম করা মাইক্রোইলেকট্রনিক অংশটা আলাদা করে টুবু আমাকে নিয়ে ককাসের কাছে রওনা দিল। পুরো ব্যাপারটি নিয়ে সে রুকাসের সাথে একবার কথা বলতে চায়।