আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি কোথায়?
তুমি আমার ঘরে।
কিরীণা কোথায়?
কিরীণা যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছে।
আমি চুপ করে ক্লডিয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ক্লডিয়ান বলল, তুমি কুনিল?
হ্যাঁ। আমি একটু থেমে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমাকে কেন এনেছ?
আমি তোমাকে দেখতে চাই।
কেন?
তুমি রুকাসকে খুব কাছে থেকে দেখেছিলে, সেজন্যে আমি তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।
কি প্রশ্ন?
সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের সময় রুকাস যখন সমুদ্রতীরের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, সেটি কি ইচ্ছাকৃত ছিল?
আমি প্রশ্ন শুনে একটু চমকে উঠলাম, ক্লডিয়ান নামের এই বায়োট আমাকে এই প্রশ্নটি কেন করছে? আমার তখন মনে হয়েছিল রুকাস জানত সে যতই জলোচ্ছাসের দিকে এগিয়ে যাবে জলোচ্ছ্বাস ততই পিছিয়ে যাবে। কিন্তু সেটা তো হতে পারে না, উন্মত্ত সমুদ্র কে তো এক জন মানুষ থামিয়ে দিতে পারে না।
ক্লডিয়ান আবার বলল, উত্তর দাও।
আমি ইতস্তত করে বললাম, আমি জানি না।
তোমার কি মনে হয়েছিল সে জানত এটি ঘটবে? উন্মত্ত সমুদ্রকে সে স্তব্ধ করে দিতে পারবে?
আমার তাই মনে হয়েছিল।
কুড়িয়ান একটি নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, ট্রন মেয়েটি যখন রুকাসকে গুলি করেছিল, রুকাস কি জানত মেয়েটি তাকে গুলি করতে পারবে না?
আমি–আমি জানি না।
তুমি খুব অবাক হয়েছিলো কেন অবাক হয়েছিলে?
তুমি কেমন করে জান আমি অবাক হয়েছিলাম?
ক্লডিয়ান শান্ত স্বরে বলল, আমরা তোমার মস্তিষ্ক স্ক্যান করেছি। তোমার মস্তিষ্কের সমস্ত তথ্য আমরা জানি। তুমি কেন অবাক হয়েছিলে?
আামার কেমন জানি সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। খানিকক্ষণ ক্লডিয়ানের ভাবলেশহীন যান্ত্রিক মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, আমার মনে হয়েছিল রুকাস জানে কেউ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
ক্লডিয়ান দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, আমাকে সত্যি কথা বলার জন্যে ধন্যবাদ।
আমি কি এখন ফিরে যেতে পারি?
যখন সময় হবে তখন তুমি ফিরে যাবে।
আমার বুক কেঁপে ওঠে, জিজ্ঞেস করলাম, কখন সেই সময় হবে?
আমি এখনো জানি না। ক্লডিয়ান পিছনে ফিরে হেঁটে চলে যেতে শুরু করে।
আমি মরিয়া হয়ে বললাম, তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?
ক্লডিয়ান থমকে দাঁড়াল, ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, কি প্রশ্ন?
তোমরা কেন মানুষ হয়ে বেঁচে না থেকে বায়োবট হয়ে বেঁচে থাকতে চাও?
যে কারণে রুকাস বায়োবট হতে চায় না, সে কারণে আমি মানুষ হতে চাই না। আমি বায়োবট সমাজে বায়োবট-শিশু হয়ে জন্মেছি। আমি বায়োবট হয়ে থাকতে চাই।
কিন্তু তোমরা শুধু বায়োবট থাকতে চাও না, যারা বায়োবট হবে না তাদের তোমরা ধ্বংস করে ফেলতে চাও।
আমরা তাদের ধ্বংস না করলে তারা আমাদের ধ্বংস করবে।
কিন্তু তোমরা যা কর সেটা অস্বাভাবিক, সেটা অপ্রাকৃতিক
আদিম মানুষ যখন প্রথমবার আগুন জ্বালিয়ে তাকে ঘিরে বসেছিল, সেদিন প্রথম অপ্রাকৃতিক কাজ করা হয়েছিল। সেই অপ্রাকৃতিক কাজ কতটুকু করা হবে, কোথায় থামতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার তোমার নেই, অর্বাচীন তরুণ।
ক্লডিয়ানের গলার স্বরে এতটুকু উত্তাপ প্রকাশ পায় না, কিন্তু আমি তবু বুঝতে পারি সে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে। আমি কেমন জানি বেপরোয়া হয়ে উঠলাম, বললাম, আমি শুনেছি তোমরা অচিন্তনীয় নিষ্ঠুর। তোমরা অবলীলায় মানুষ হত্যা কর।
এই মুহূর্তে তোমার শরীর কয়েক লক্ষ ব্যাকটেরিয়াকে হত্যা করছে। ব্যাকটেরিয়াকে হত্যা করা হলে সেটি নিষ্ঠুরতা নয় কেন?
সেটি করতে হয় বেঁচে থাকার জন্যে।
আমরাও হত্যা করি বেঁচে থাকার জন্যে। আমরাও হত্যা করি প্রয়োজনে। প্রয়োজনের হত্যাকাণ্ড নিষ্ঠুর হতে পারে না।
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে একটি অসমসাহসিক কাজ করে ফেললাম, বললাম, আমি কি তোমার জৈবিক শরীরটি দেখতে পারি? তোমার অপুষ্ট শরীর? তোমার বিকৃত বিকলাঙ্গ দেহ?
ক্লডিয়ানের শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে। আমি বুঝতে পারি প্রচণ্ড ক্রোধে সে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি, এক মুহূর্তে নিশ্চয়ই প্রচণ্ড আঘাতে আমার বক্ষ বিদীর্ণ করে ফেলবে। কিন্তু ক্লডিয়ান সেটি করল না, তার বদলে একটি বিচিত্র ব্যাপার ঘটল। ক্লডিয়ান হঠাৎ হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত সেটি সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, পারল না। শেষ পর্যন্ত একটি ঝটকা দিয়ে সেটি উঠে দাঁড়াল, তারপর ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আমি হতবাক হয়ে বসে রইলাম।
আমি যেখানে আছি সেই ঘরটির মনে হয় কোনো শুরু নেই কিংবা কোনো শেষ নেই। যতদূর দেখা যায় বিশাল শূন্যতা। উপরে তাকিয়ে থাকলে বুকের ভেতর গভীর শূন্যতায় হা হা করে ওঠে। আমি প্রথম প্রথম ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করি; আজকাল চুপচাপ বসে থাকি। আমি জানি না আমাকে কেন এখানে এনেছে, আমি জানি না কখন আমাকে যেতে দেবে। শুয়ে শুয়ে আমার ঘুরেফিরে কিরীণার কথা মনে হয়। পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে ছিলাম দু’জনে, হঠাৎ করে আমাকে ছিনিয়ে এনেছে, কিরীণার কী হয়েছে তখন? তাকেও কি ধরে এনেছে ওরা? আমার মতো সেও কি বিশাল শূন্য এক প্রান্তরে বসে আমার কথা ভাবছে?
মাঝে মাঝে আমার চোখে গভীর ঘুম নেমে আসে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখি! সেই স্বপ্নের কোনো অর্থ নেই, কোনো ব্যাখ্যা নেই। কে যেন আমাকে বিচিত্র সব প্রশ্ন করে, আমি তার উত্তর ভেবে পাই না।