ইলির বাসায় সন্ধেবেলা সবাই একত্র হয়েছে। প্রথমে ছোটখাট একটা বক্তৃতা দিয়ে ইলি বলল, আপনারা সবাই জানেন, আমরা ট্রনেদের এলাকায় আঘাত হানার মতো ক্ষমতা অর্জন করেছি। আমাদের কয়েকজন কিশোর-কিশোরী পুরো ব্যাপারটিতে এত দক্ষতা অর্জন করেছে যে কিছুদিনের মাঝেই তারা ইচ্ছে করলে পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত কিছু ট্রন-বিমানকে আকাশে উড়িয়ে নিতে পারে, পারমাণবিক বোমা ফেলে তাদের শহর-নগর ধ্বংস করে দিতে পারে। এটি অচিন্তনীয় ক্ষমতা, কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের কিশোর-কিশোরীদের সেই ধরনের একটা ক্ষমতা অর্জন করতে দেয়া ঠিক নয়, আমাদের এখনই সতর্ক হওয়া উচিত।
আমি লক্ষ করলাম, যেসব কিশোর-কিশোরী গত কয়েকদিন কম্পিউটারের মনিটরের সামনে অসাধ্য সাধন করেছে, তারা হঠাৎ করে নিজেদের ভেতরে গলা নামিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। ইলি একসময় থেমে গিয়ে বলল, তোমরা কিছু বলবে?
ডিয়াল মাথা নাড়ল।
কী বলবে?
তুমি যেটা বলেছ আমরা আসলে সেটা ইতোমধ্যে করে ফেলেছি।
ইলি চমকে উঠে বলল, কি করে ফেলেছ?
পারমাণবিক বোমা নিয়ে কুড়িটা প্লেনকে আকাশে উড়িয়ে দিয়েছি।
কী বললে? কী-কী-বললে?
কুড়িটা প্লেন গত দুই ঘন্টা থেকে ট্রনেদের আকাশে উড়ছে। কেন?
আমরা ওদের বলেছি, আমাদের যাদের ওরা ধরে নিয়ে গেছে, তাদের সবাইকে আজ রাতের মাঝে ফিরিয়ে দিতে হবে।
আমার হঠাৎ করে মনে পড়ল ডিয়াল নামের এই কিশোরটির মা অত্যন্ত রূপবতী মহিলা, গতবার ট্রনেরা তাকে ধরে নিয়ে গেছে। ডিয়ালের বাবা তার কিছুদিনের মাঝেই আত্মহত্যা করেছে। সে নিজে সেই থেকে আমার মায়ের অনাথাশ্রমে বড় হচ্ছে।
ইলি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, যদি ওরা ফেরত না দেয়?
ডিয়াল শান্ত স্বরে বলল, তাহলে প্রতি এক ঘন্টায় একটা করে বোমা ফেলা হবে।
তু-তু-তুমি জান একটা পারমাণবিক বোমা ফেললে কত জন মানুষ মারা যায়? জা-জা-জান? উত্তেজনায় ইলির মুখে কথা আটকে যেতে থাকে।
ডিয়াল মাথা নাড়ল, জানি। তারপর আস্তে আস্তে বলল, আমার মাকে বাঁচানোর জন্যে দরকার হলে আমি পৃথিবীর সব মানুষকে মেরে ফেলব।
কেউ কোনো কথা বলল না।
ভোররাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল একটি হেলিকপ্টারের শব্দে। আমাদের কোনো হেলিকপ্টার নেই, নিশ্চয়ই ট্রনদের হেলিকপ্টার। ডিয়ালের মা এবং অন্যান্যদের ফিরিয়ে দিতে এসেছে ট্রনেরা।
আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারি, আর আমাদের পশুদের মতো বেঁচে থাকতে হবে। পৃথিবীর মাঝে মানুষের মতো বেঁচে থাকতে পারব প্রথমবারের মতো।
০৮. ক্লডিয়ান
কয়দিন থেকে রুকাস এবং টুবুকে একটু চিন্তান্বিত মনে হচ্ছে। রুকাসের মুখে চিন্তার ছায়া পড়ে, কিন্তু টুবুর মুখে তার কোনো চিহ্ন পড়ার উপায় নেই। তবুও আমার টুবুকে দেখেই মনে হল কিছু-একটা ঘটছে। সে আজকাল কথা বলে কম, কয়েকবার প্রশ্ন করলে প্রশ্নের উত্তর দেয় এবং তার উত্তরগুলো হয় সংক্ষিপ্ত। দীর্ঘ সময় সে লাল রঙের ত্রিমাত্রিক ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘরের অসংখ্য মনিটরে কী যেন খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখে এবং মাঝে মাঝেই ক্লাসের সাথে তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে।
আমি একসময় জিজ্ঞেস করলাম, রুকাস, কী হয়েছে? তোমাদের দেখে মনে হয় কিছু-একটা ঘটেছে।
হ্যাঁ, মনে হয় তারা এসেছে।
কারা?
বায়োবটেরা।
তারা কোথায়?
সেটাই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে এখানেই আছে, কিন্তু দেখতে পারছি না। কেমন যেন ফাঁকি দিয়ে বেড়াচ্ছে।
কেন তাদের দেখতে পারছি না?
টুবু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, মনে হয় সময় মাত্রায় সবসময় একটু এগিয়ে রয়েছে, আমরা কিছুতেই ধরতে পারছি না, কিছু-একটা পরিকল্পনা করছে। ওরা। এইখানেই আছে ওরা আমাদের আশেপাশে।
আমার হঠাৎ করে কেন জানি গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। চারদিকে তাকিয়ে বললাম, এখনো তো কাউকে দেখি নি।
হঠাৎ করে দেখবে। মনে হয় হঠাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিছু বোঝার আগে।
সত্যিই তাই হল।
আমি আর কিরীণা পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সন্ধে হয়ে আসছে। একটু পরেই অন্ধকার নামবে। হঠাৎ করে মাটি খুঁড়ে চারটি মূর্তি বের হয়ে এল। আমরা একটা শব্দ করার আগে মুক্তি চারটি আমার হাত ধরে কোথায় যেন লাফিয়ে পড়ল। সাথে সাথে চারদিক ঝাঁপসা হয়ে মিলিয়ে গেল। সামনে অন্ধকার একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে, চারটি মূর্তি আমাদের দুজনকে ধরে নিচে নামিয়ে নিতে থাকে। চারদিকে কেমন জানি অবাস্তব ঘোরের মতো, আমি প্রাণপণ চেষ্টা করি চোখ খোলা রাখতে, কিন্তু চোখের উপর ভারী পর্দার মতো কী যেন নেমে আসে।
আমার মাঝে মাঝে ভাসা ভাসা জ্ঞান এসেছে, আবার অচেতন হয়ে গেছি। মনে হয়েছে কেউ-এক জন আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টির সামনে আমি ভয়ে আতঙ্কে কুঁকড়ে গেছি। এইভাবে কতকাল গিয়েছে কে জানে। মনে হয় এক যুগ মনে হয় এক শতাব্দী। তারপর শেষ পর্যন্ত একদিন আমি চোখ খুলে তাকিয়েছি। আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে একটি ধাতব মুখ। আমি চোখ খুলতেই মুখটি সরে গেল, আমি উঠে বসে জিজ্ঞেস করলাম, কে?
আমি ক্লডিয়ান।
ক্লডিয়ান।
আমি ভালো করে তাকালাম। এই তাহলে সেই বায়োবট দলপতি? মানুষের সমান উঁচু দেহ। প্রায় মানুষের মতোই যান্ত্রিক চেহারা। গোলাকার এনোডাইজ অ্যালুমিনিয়ামের মতো কালো মাথা। সরু সরু সবুজ একজোড়া নিস্পলক চোখ। নাক আর মুখের জায়গায় ত্রিকোনাকৃতি ফুটো, ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে জটিল সংবেদনশীল যন্ত্র। কুস্তিগীরদের মতো বিশাল দেহ। সমস্ত দেহে প্রচণ্ড শক্তির একটা ছাপ। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ, দুই পা বিস্তৃত করে ক্লডিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে আছে।