দিনের বেলা আমি খামারের কাজ করি। খুব অল্প খানিকটা জমিতে চাষ-আবাদ করা যায়। সেটা খুব যত্ন করে ব্যবহার করা হয়। যারা বড়, তারা জমি চাষ করা, সার দেয়া,বীজ বোনা এইসব খাটাখাটনির কাজগুলো করে। আমরা, যাদের অভিজ্ঞতা কম, তারা ছোট ছোট গাছের চারাগুলোর দেখাশোনা করি। ঘরে তৈরি করা গ্রো মনিটর দিয়েচারাগুলোকে পরীক্ষা করি। পুরানো শুকনো পাতা টেনে ফেলি,নতুন পাতাগুলোকে ভালো করে ধুয়ে-মুছে রাখি। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে এই গাছগুলোকে তৈরি করা হয়েছে, বড় একটা গাছে একদিনে এক জন মানুষের প্রয়োজনীয় শ্বেতসার বের হয়ে আসে। সমস্যা হচ্ছে পানি এবং সার। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পানি টেনে আনা হয় অনেক কষ্ট করে। সার কোথা থেকে আসবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মধ্য অঞ্চল থেকে অনেক কষ্ট করে গোপনে সার আনার চেষ্টা করা হয়। বহুদিন থেকে সার তৈরি করার উপর একটা বই খোঁজা হচ্ছে, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না।
সূর্য ড়ুবে গেলে আমি বাসায় ফিরে আসতে থাকি। আমার বাসা একেবারে অন্য পাশে। অনেকটা পথ হেঁটে হেটে আসতে হয়। আমার সাথে যারা কাজ করে তাদের প্রায় সবারই বাই-ভার্বাল আছে। সত্যিকার বাই-ভার্বাল নয়, ছোট একটা ইঞ্জিনের সাথে জোড়াতালি দেয়া কিছু যন্ত্রপাতি। সত্যিকার বাই-ভার্বাল যেরকম যতক্ষণ খুশি বাতাসে ভেসে থাকতে পারে; এগুলো সেটা পারে না। ছেলেরা পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে উপরে যায়, সেকেন্ড খানেকের মাঝে আবার নিচে নেমে আসে, আবার পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে উপরে উঠে যেতে হয়। একটা অতিকায় ঘাসফড়িঙের মতো ঘরে তৈরি করা বাইভার্বালগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে দুরত্ব অতিক্রম করে।
আমার বাই-ভার্বাল নেই, খামারের কাজ করে আমার যেটুকু সঞ্চয় হয়েছিল, সেটা দিয়ে আমি ক্রিস্টাল রিডার কিনেছি। ক্রিস্টাল রিডার বেজাইনি জিনিস, গোপনে কিনতে হয়। সে কারণে তার অনেক দাম। ইলি অবশ্যি আমাকে খুব কম দামে দিয়েছে। ইলি মনে হয় আমাকে একটু পছন্দই করে। আমি বাসায় যাবার আগে প্রতিদিন সন্ধেবেলা ইলির বাসায় একার উঁকি দিয়ে যাই।
ইলির বাসায় সব সময়েই কেউ-না-কেউ থাকে। আজকেও ছিল। খামারের দু’জন, ক্লডিন আর দুরিণ, নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের শুলা এবং রুশ নামে এক জন মেকানিক। আমাকে দেখে ইলি সস্নেহে বলল, কি খবর কুনিল? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কিছুদিনের মাঝেই এক জন বড়মানুষে পরিণত হবে।
ইলি কী ভাবে জানি বুঝতে পেরেছে আমার খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাবার ইচ্ছে। মাঝে মাঝে তাই আমাকে এই কথাটি বলে।
রুখের কপালের দু’ পাশের চুল সাদা হয়ে এসেছে। মাথা নেড়ে বলল, কুনিল যদি তার বাবার মতো হয়, তাহলে সে যে অত্যন্ত সুপুরুষ হবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
শুলা বলল, চেহারার প্রয়োজন নেই, কুনিল যেন তার বাবার বুদ্ধি আর জ্ঞানটুকু পায়।
সবাই তখন একসাথে মাথা নাড়ে। ক্লডিন আস্তে আস্তে বলে, তোমরা বিশ্বাস করবে না, আমি এখনো কুশানের অভাবে অভ্যস্ত হতে পারি নি।
কুশান আমার বাবার নাম। আমার বাবাকে আমি কখনো দেখি নি। আমার জন্মের আগেই আমার বাবাকে ট্রনেরা মেরে ফেলেছিল। এই এলাকায় মানুষদের মাঝে যে ছোট সভ্যতাটি গড়ে উঠেছে, সেটি নাকি আমার বাবার প্রচেষ্টার ফসল। ট্রনেরা ইচ্ছে করলেই আমাদেরকে বা যারা আমাদের মতো নানা জায়গায় বেঁচে আছে, তাদের ধ্বংস করে ফেলতে পারে। তারা কোনো কারণে সেটি করছে না। আমাদেরকে কখনোই পুরোপুরি ধ্বংস করে নি সত্য, কিন্তু তারা কখনোই চায় না আমরা সভ্য মানুষের মতো থাকি। তারা চায় আমরা পশুর মতো বেঁচে থাকি, নিজেদের মাঝে খুনোখুনি করে একে অন্যকে ধ্বংস করে। তাই মাঝে মাঝে তারা এসে আমাদের সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে যায়। নির্মমভাবে মানুষদের হত্যা করে। আগে হত্যাকাণ্ড গুলো ছিল বিক্ষিপ্ত। আমাদের এই ছোট সভ্যতাটি গড়ে ওঠার পর হত্যাকাগুলো বিক্ষিপ্ত নয়, এখন হত্যাকাণ্ডগুলো সুচিন্তিত। যারা নেতৃত্ব দেয় বা দিতে সক্ষম, তাদেরকে বেছে বেছে হত্যা করা হয়। আমাদের বই পড়া নিষেধ, যারা বই পড়ে তাদের খুঁজে বের করে হত্যা করা হয়। আমাদের যে লাইব্রেরি ছিল, তার প্রত্যেকটি বইকে ধ্বংস করা হয়েছে। আজকাল তাই প্রকাশ্যে বই পড়া হয় না। বই পড়তে হয় গোপনে। সবাই পড়ে না, যাদের সাহস আছে শুধু তারাই পড়ে।
আমার বাবার চেষ্টায় এখানে একটি ছোট সভ্যতা গড়ে উঠেছে। যত ছোটই হোক, এটা আমাদের নিজেদের সভ্যতা। আমরা একে-অন্যকে ধ্বংস করে বেঁচে থাকি না। সবাই মিলে একসাথে বেঁচে থাকি। শেষবারের ট্রনদের ভয়ংকর আক্রমণে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবার পর আবার সবকিছু গোড়া থেকে তৈরি করতে হয়েছে। সেটি উল্লেখযোগ্য নয়, উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, সবাই একতাবদ্ধ থেকে আবার সবকিছু গড়ে তুলেছে। কেউ আর বিক্ষিপ্ত পশুর জীবনে ফিরে যায় নি।
সবাই মনে করে এর পুরো কৃতিত্বটুকু আমার বাবার। সমুদ্রতীরে বাবার শরীরটিকে অ্যাটমিক ব্লস্টার দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেবার আগে বাবা নাকি ছোট একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ট্রনেরা আমাদের ভাষা বুঝতে পারে না, বুঝতে পারলে বাবাকে তারা সেই কথাগুলো বলতে দিত না। বাবা তখন বলেছিলেন, এই পৃথিবীতে ট্রনদের যতটুকু অধিকার, আমাদের ঠিক ততটুকু অধিকার। আমরা যদি একতাবদ্ধ থাকি, শুধু তাহলেই ট্রনেরা আমাদের ধ্বংস করতে পারবে না। শুধু যে ধ্বংস করতে পারবে না তা-ই নয়, আমরা আবার আমাদের অধিকার নিয়ে ট্রনদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব। বাবা সবাইকে একটা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন সবাইকে পাল্টে দিয়েছে। আগে বেঁচে থাকা ছিল অর্থহীন, এখন বেঁচে থাকার একটা সুনির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে। এখানকার সব মানুষের বাবার জন্যে তাই রয়েছে এক আশ্চর্য ভালবাসা। আমি বুঝতে পারি সেই ভালবাসার অংশবিশেষ আমার জন্যেও সবার বুকের মাঝে আলাদা করে রাখা আছে।