ইলির ঘরে বড় একটি কম্পিউটার খোলা অবস্থায় পড়ে ছিল। নানা আকারের কিছু মনিটরে দুর্বোধ নানাধরনের ছবি ও সংকেত খেলা করছে। টুবু একনজর দেখে হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, বলল, একটা সহজ জিনিসকে এত জটিল করছেন কেন?
ইলি মাথা চুলকে বলল, আমি তো কিছু করি নি, যেরকম পেয়েছি সেরকমই আছে।
টুকু বলল, এই যন্ত্রণার মাঝে না গিয়ে গোড়া থেকে করে দিলে কেমন হয়?
ইলি ইতস্তত করে বলল, গোড়া থেকে?
হ্যাঁ, ঘন্টাখানেক সময় নেবে।
ঘ-ঘ-ঘন্টাখানেক? মাত্র ঘন্টাখানেক?
হ্যাঁ। এটা কতদিন থেকে এভাবে আছে?
এক বছরের একটু বেশি হল।
টুবু আবার হতাশ হবার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে কাজ শুরু করে দিল।
উবু একটি রবোট এবং তাকে তৈরি করা হয়েছে মানুষের সাথে কাজ করার জন্যে। কাজেই তার আচার-ব্যবহার মানুষের মতো, তার অঙ্গ-সঞ্চালনও মানুষের মতো। কিন্তু ইলির জন্যে এই কম্পিউটারটি দাঁড় করিয়ে দেবার সময়টিতে আশেপাশে কোনো মানুষ নেই, কাজেই তার মানুষের মতো অঙ্গ-সঞ্চালন করারও প্রয়োজন নেই। টুব দ্রুত কাজ করতে শুরু করে, তার হাত এত দ্রুত নড়তে থাকে যে আমরা সেটিকে প্রায় দেখতে পাচ্ছিলাম না। মনে হতে থাকে একটি অতিকায় পতঙ্গ ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উবু এক ঘন্টার আগেই কাজ শেষ করে ফেলল। ইতস্তত বড় বড় মনিটরে বিচিত্র ছবি খেলা করতে থাকে। টুকু বলল, কাজ শুরু করার জন্যে মোটামুটি তৈরি হয়েছে। আজকাল আপনারা কী ভাবে মূল কেন্দ্রে যোগাযোগ করেন জানি না। আপানাদের নিজস্ব কি ডাটাবেস আছে?
ইলি মাথা চুলকে বলল, আমাদের নেই, গড়ে তুলতে হবে।
নেই?
না। ট্রনেদের যেটা আছে সেটা ব্যবহার করছেন না কেন?
ইলি আকাশ থেকে পড়ল, সেটা কেমন করে করব? যোগাযোগ করব কেমন করে? আর যোগাযোগ বৃদি করিও, আমাদের ব্যবহার করতে দেবে কেন?
কেন দেবে না? সেটা আমার উপর ছেড়ে দিন। টুবু একটা মনিটরের সামনে বসে দ্রুত কিছু সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণেই ট্রনেদের মূল কম্পিউটারে যোগাযোগ করে ফেলল। মনিটরে বিচিত্র সংখ্যা এবং ছবি খেলা করতে থাকে। ইলিকে দেখিয়ে বলল, এই যে মূল কম্পিউটারের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুটি। এখান থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
সবকিছু।
হ্যাঁ, সবকিছু।
এখানে এত সহজে যাওয়া যায়?
আপনারা এত সহজে যেতে পারবেন না। বিশাল দু’টি প্রাইম সংখ্যা ব্যবহার করে এর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে, কিন্তু আমাদের জন্যে সেটি তো কোনো সমস্যা। নয়।
তার মানে আমরা এখন ট্রনেদের মূল নিয়ন্ত্রণে কী হচ্ছে দেখতে পারব?
শুধু দেখতে পাবেন না, সেটা নিয়ন্ত্রণও করতে পারবেন।
তার মানে আমরা যদি এটা ব্যবহার করা শিখে যাই—আজ থেকে এক মাস কিংবা দুই মাস পরে—আমরা ট্রনদের হামলা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারব?
এক মাস দু’মাস পরে কেন? এখনই, এই মুহূর্তে আপনারা নিরাপদ।
কিন্তু এই জটিল সফটওয়ার তো আমরা ব্যবহার করতে পারি না। শিখতে সময় নেবে। এই ধরনের ব্যাপারে অভিজ্ঞ মানুষ খুব কম। বেশির ভাগ মানুষই এখানে অন্য ধরনের কাজ করে।
টুর মনে হল সমস্যাটি ঠিক বুঝতে পারছে না। খানিকক্ষণ ইলির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, মানুষ কম বলছেন কেন? এই যে বাচ্চারা খেলছে, তাদের কাজে লাগিয়ে দিন।
বাচ্চাদের?
হ্যাঁ। বারো-তেরো বছরের বাচ্চা এসব কাজের জন্যে সবচেয়ে ভালো, মস্তিষ্ক মোটামুটি তৈরি হয়ে গেছে, দায়িত্ববোধের জন্ম নিচ্ছে, নূতন জিনিস শেখার জন্যে এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে?
কিন্তু তাদের শেখাবে কে?
শেখাবে? টুবুকে আবার একটু বিভ্রান্ত মনে হল। বলল, আপনাদের মস্তিষ্কে তথ্য পাঠানোর সরাসরি ব্যবস্থা নেই?
ইলি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, সেটা কী জিনিস?
মস্তিষ্কের নিউরনে তথ্যগুলো সোজাসুজি পাঠিয়ে দেয়া হয়। একটা বিদাৎচৌম্বকীয় যন্ত্র। আমার কাছে আছে, রুকাসকে আপনাদের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে শেখানোর জন্যে এনেছিলাম। সেটা ব্যবহার করে সবাইকে শিখিয়ে দেব।
ছোট ছোট বাচ্চারা, যারা এতক্ষণ মজা দেখার জন্যে জানালায় ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল, তারা কিছুক্ষণের মাঝেই মনিটরের সামনে বসে পড়ে। টুব ছোট যন্ত্রটি ব্যবহার করে মস্তিস্কে কম্পিউটারসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী পাঠিয়ে দেবার পর তারা অবিশ্বাস্য দক্ষতায় কাজ শুরু করে। বাইরে অন্ধকার নেমে আসতে থাকে, কিন্তু কাউকে মনিটরের সামনে থেকে নাড়ানো যাচ্ছিল না।
পরদিন বিকেলবেলা ডিয়াল নামে এগারো বছরের একটি ছেলে প্রথমবার ট্রনেদের একটি মহাকাশযানকে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হল। পুরো ব্যাপারটি ঘটুল ইলির ঘর থেকে। মহাকাশযানটির পুরো নিয়ন্ত্রণ দখল করে সেটিকে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে উত্তরাঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ে আঘাত করে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া হল। মনুষ্যবিহীন এই মহাকাশযানটি কী ভাবে আকাশে উড়ে ধ্বংস হয়ে গেল বের করার আগেই ট্রনেদের এলাকায় আরো বিচিত্র ব্যাপার ঘটতে থাকে। দক্ষিণাঞ্চলের বৈদ্যুতিক সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল, মধ্য অঞ্চলের যাবতীয় যোগাযোগব্যবস্থা অনিশ্চিত করে দেয়া হল এবং খাদ্য সরবরাহের একটি মূল ব্যবস্থা হঠাৎ করে অকেজো হয়ে গেল।
এত দ্রুত এত বড় একটি ব্যাপার ঘটতে পারে, সেটি সবার ধারণার বাইরে ছিল। কম্পিউটারের মনিটরের সামনে বসে অল্প কয়জন কিশোর-কিশোরী ট্রলদের জগতে এত বড় বিপর্যয় ঘটাতে পারে জানার পর সবাই হঠাৎ করে ব্যাপারটি আরো গুরুত্ব দিয়ে যাচাই করতে শুরু করে। বিপর্যয়টি চোখের সামনে ঘটছে না, কাজেই সবার অগোচরে অত্যন্ত হৃদয়হীন মর্মান্তিক ব্যাপার ঘটে যেতে পারে।