কিরীণা বলল, ট্রনেরা যেসব রবোর্ট ফেলে গেছে, বাচ্চারা সেগুলো দেখতে গেছে। কাছে যাওয়ার কথা নয়, তাই দূর থেকে ঢিল ছুড়ছে।
তাদের কাছে তো ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর অস্ত্র, গুলি করে দেবে কখন।
টুবু রবোট কথাটি উচ্চারিত হতে শুনে কৌতূহলী হয়ে উঠল। আমি তখন পুরো ব্যাপারটি তাকে খুলে বললাম। সব শুনে বলল, চল গিয়ে দেখে আসি ব্যাপারটা কি।
কিরীণা এবং তার বান্ধবীরাও বলল, আমরাও যাব। চল।
আমরা কথা বলতে বলতে সমুদ্রতীর ধরে হাঁটতে থাকি। টুর একটু বাক্যবাগীশ বলে মনে হয়, কথাবার্তায় সে-ই মোটামুটি প্রাধান্য নিয়ে নিল।
ট্রনেরা প্রায় হাজারখানেক রবোট ফেলে গিয়েছিল। অনুসন্ধানকারী রবোট, কিছু দেহরক্ষী, কিছু আক্রমণকারী রবোট। ট্রনেরা না থাকায় তাদের নেতৃত্ব দেয়ার কেউ নেই। কোনো ধরনের নেতৃত্ব দেয়া না হলে রবোট গুলো পুরোপুরি অক্ষম হয়ে যায় বলে মনে হচ্ছে। সম্ভবত এগুলোকে সেভাবেই প্রোগ্রাম করা হয়েছে। সমুদ্রতীরের এক নির্জন এলাকায় রবোটগুলো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। সেগুলো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নেই, ক্রমাগত নিজেদের মাঝে স্থান বদল করছিল, দুর থেকে মনে হয় কিছু অতিকায় কীট কিলবিল করছে। আমরা হেঁটে হেঁটে কাছে এসে দেখতে পাই এই এলাকার প্রায় সব শিশু এই রবোটগুলোকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। মোটামুটি অক্ষম এবং পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন এই রবোটগোষ্ঠীকে শিশুগুলো নানাভাবে জ্বালাতন করছে। বড় বড় পাথরের টুকরা জড়ো করা হচ্ছে এবং বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মাঝে সেগুলো ছুড়ে রবোটগুলোর কপোট্রনে আঘাত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। শিশুদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, খর্বাকৃতি অনুসন্ধানকারী রবোটের কপেট্রনের ডান দিকে মাঝারি পাথর দিয়ে বেশ জোরে আঘাত করতে পারলে রবোটটি পুরোপুরি মাখা-খারাপ হয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে আকাশে গুলি করতে থাকে। সেটি নাকি নিঃসন্দেহে একটি দর্শনীয় ব্যাপার।
টুবু খানিকক্ষণ রবোটগুলো লক্ষ করে বলল, বাচ্চারা যদি এগুলো দিয়ে খেলতে চায় খেলুক। কিন্তু আগে এগুলোকে নিরস্ত্র করা দরকার।
কেমন করে করবে?
বললেই হয়।
কাকে বলবে?
কেন, রবোট গুলোকে। ঠিক ফ্রিকোয়েন্সিতে কিছু বিট পাঠিয়ে রিসেট করে নিলেই হল। মাস্টার মোড়ে গিয়ে ওদের যা কিছু বলা হবে ওরা সেটাই করবে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি করতে পারবে সেটা?
কেন পারব না?
কর দেখি।
কি করব?
আমি মাথা চুলকে বললাম, সবগুলো রবোটকে বল হাতের অস্ত্রগুলো ফেলে আমাদের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াতে। টুকু এগিয়ে গিয়ে যান্ত্রিক ভাষায় কী একটা বলতেই সবগুলো রবোট গা-ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ায়। হাতের অস্ত্র ফেলে সবগুলো পড়িমরি করে ছুটে আসতে থাকে। টুবুর কাছাকাছি এসে রবোটগুলো মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। প্রথমে অনুসন্ধানকারী রবোট, তার পিছনে দেহরক্ষী রবোট, সবার পিছনে আক্রমণকারী রবোট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে রবোটগুলো আদেশের জন্যে অপেক্ষা করছে।
কিরীণা বিস্ফারিত চোখে বলল, তার মানে ট্রনেদের রবোটগুলো এখন আমাদের রোট হয়ে গেল? এখন এগুলো আমাদের কথা শুনবে?
টুবু মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। তোমরা যদি চাও।
ব্যাপারটি পরীক্ষা করে দেখার জন্যে বিশাল রবোটবাহিনী নিয়ে আমরা শহরতলিতে ফিরে চললাম। সবার সামনে টুকুকে নিয়ে আমি আর কিরীণা, পিছনে সারিবদ্ধ রবোর্ট। একেকটা শিশু একেকটা রবোটের ঘাড়ে চেপে বসেছে, মাথায় চাটি মারছে, পা দিয়ে শব্দ করছে, কান ধরে টানছে, রবোটগুলো বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ না করে হাঁটছে। এককথায় বলা যায়, একটি অভূতপূর্ব দৃশ্য।
শহরের মাঝামাঝি ইলির সঙ্গে দেখা হল। ট্রনেদের রবোটগুলো পোষমানা অনুগত ভূতের মতো ব্যবহার করছে খবর পেয়ে সে ছুটে আসছিল। খানিকক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে আমার কাছে ছুটে এল। উত্তেজিত গলায় বলল, কী হচ্ছে এটা কুনিল? কী হচ্ছে?
আমি টুকুকে দেখিয়ে বললাম, এ হচ্ছে টুবু। রুকাসের বন্ধু। গতরাতে এসেছে।
ব্যক্তিগত জীবনে এক জন রবোট।
টুবু আবার মৃদু স্বরে মনে করিয়ে দিল, সপ্তম বিবর্তনের চতুর্থ পর্যায়ের ষষ্ঠ প্রজাতির রবোট।
আমি ইলিকে দেখিয়ে বললাম, এ হচ্ছে ইলি। আমাদের বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার এবং শিক্ষক।
টুবু মাথা নিচু করে অভিবাদন করে বলল, রুকাসকে আশ্রয় দেয়ার জন্যে আপনাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ইলি ইতস্তত করে বলল, তু-তুমি সবগুলো রবোটকে ঠিক করে দিয়েছ?
হ্যাঁ।
কেমন করে করলে?
সব ডিজিটাল সিগনালে কাজ করে, অসুবিধে কোথায়?
তুমি আমার একটা কম্পিউটার ঠিক করে দিতে পারবে? অনেক কষ্ট করে আনা হয়েছে, কিন্তু মুল সিস্টেমে কী একটা সমস্যা রয়ে গেছে।
মনে হয় পারব। এই রবোট গুলো নিয়ে কী করবেন ঠিক করেছেন। আমি এর কর্তৃত্ব আপনাদের কারো হাতে তুলে দিতে চাই।
রবোটগুলোর একটা ব্যবস্থা করতে গিয়ে সারাদিন কেটে গেল। পুরো এলাকার নানারকম কাজকর্মে এদের জুড়ে দেয়া হল। রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে একমাত্র নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরটির নিয়ন্ত্রণ কিছুই বাকি রইল না। আমাদের পুরো এলাকাটি, যেটি মাত্র গতকালও মোটামুটি মধ্যযুগীয় হিসেবে চালিয়ে দেয়া যেত, রাতারাতি সেটা আধুনিক হয়ে গেল।
রবোর্টসংক্রান্ত জটিলতা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ইলি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল টুবুকে নিয়ে তার কম্পিউটারের সমস্যাটির একটি সমাধান করার জন্যে। আমি একদিন বিকেলে রুকাস এবং টুকে নিয়ে বের হলাম। পথে যেতে যেতে কিরীণা আমাদের সাথে যোগ দিল এবং টুকে দেখে বরাবরের মতোই অসংখ্য ছোট ছোট শিশু আমাদের সাথে রওনা দিল। টুবু একটি রবোট ছাড়া কিছু নয়, মানুষের জন্যে তার অফুরন্তু ভালবাসা, বিশেষ করে শিশুদের জন্যে। সম্ভবত দুই হাজার বছর ভবিষ্যতের যে এলাকা থেকে সে এসেছে সেখানকার অল্পকিছু মানুষকে বায়োবটের ভয়ঙ্কর নির্যাতন সহ্য করতে দেখে মানুষ সম্পর্কে তার ধারণা চিরকালের জন্যে পাল্টে গেছে।