তার মানে তোমরা এখানে যুদ্ধ-বিগ্রহ করতে পারবে না?
না।
মানুষ মারতে পারবে না?
না।
কোনো কিছু ধ্বংস করতে পারবে না?
না।
কিন্তু রুকাস ঠুনদের তিনটি মহাকাশযান ধ্বংস করে ফেলেছিল।
প্রকৃতি তাকে সেটা করতে দিয়েছে—
আমার মা এই সময়ে আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, সব সময়ে এই কচকচি ভালো লাগে না তুই থাম দেখি, আমি কয়েকটা কাজের কথা বলি।
বলুন।
আজকাল কাপড় নিয়ে মহাযন্ত্রণা। তাপ-নিরোধক কাপড়গুলো যাচ্ছেতাই, ভালো কিছু তাপ-নিরোধক পাওয়া যায় কোথাও?
কী করবেন আপনি তাপ-নিরোধক কাপড় দিয়ে?
এই রান্নাবান্নার সময় কাজে লাগে। সেদিন ছোট একটা মাইক্রোভস্ট ফেটে কী কেলেঙ্কারি। এই যে দেখ বাবা, হাতটা পুড়ে গেছে।
রবোটের মুখে যেটক যান্ত্রিক সমবেদনা ফোটানো সম্ভব সেটুকু ফুটিয়ে টুকু গভীর মনোযোগ নিয়ে মায়ের হাতের পোড়া দাগটি লক্ষ করে বলল, খুবই দুঃখের ব্যাপার। আপনি কেমন করে রান্না করেন?
ছোট একটা ইউরেনিয়াম চুলো আছে, কতদিনের পুরানো, কে জানে রেডিয়েশান বের হয় কি না। তোমরা কেমন করে কর?
আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এক জন রবোট বলে খাওয়াদাওয়ার ঝামেলা নেই। মানুষদের জন্যে খাবার তৈরি করতে হয়। খাওয়া ব্যাপারটি আজকাল দু ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়েছে—শরীরের পুষ্টি এবং স্বাদ। পুষ্টির ব্যাপারটি ছোট ছোট ট্যাবলেটে করে চলে আসে। সেখানে ইচ্ছেমতো স্বাদ যোগ করা হয়।
মা অবাক হয়ে বললেন, তার মানে একই খাবারের ট্যাবলেটে মাংসের স্বাদ যোেগ করা যাবে, আবার ইচ্ছে করলে মাছের স্বাদ?
ঠিক বলেছেন।
মা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, স্বাদগুলো কেমন করে যোগ কর? বোতলে কিনতে পাওয়া যায়?
আগে সেরকম ছিল। গত শতাব্দীতে পুরো ব্যাপারটি ইলেকট্রনিক করে ফেলা হয়েছে।
ই-ইলেকট্রনিক?
হ্যাঁ। স্বাদ জিনিসটা কী? আপনাদের মস্তিষ্কের একধরনের অনুভূতি। একটা খাবার মুখে দেবেন, জিব, গলা, নাক, মুখমণ্ডল সেই খাবারের অনুভূতিটি মস্তিষ্কে পাঠাবে, আপনারা সেটা উপভোগ করবেন। পুরো জিনিসটি শর্টকাট করে অনুভূতিটি সোজাসুজি মস্তিষ্কে দেয়া যায়, ছোট ছোট ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি পাওয়া যায় সেসব করার জন্যে।
মা তখনো ব্যাপারটি বুঝতে পারছেন না। মাথা নেড়ে বললেন, মুখে কোনো খাবার দিয়েই খাবারের স্বাদ অনুভব করা সম্ভব।
হ্যাঁ।
তোমরা সেটা কর?
আমি রবোট, তাই আমাকে করতে হয় না, মানুষেরা করে।
প্রত্যেক দিন করে? প্রত্যেক বেলায়?
টুবু আবার হাসির মতো একটু শব্দ করে বলল, প্রত্যেক বেলায় খাওয়ার সময় আর কতজনের আছে? যাদের সময় আছে, তারা দিনে একবার। ব্যস্ত মানুষেরা সপ্তাহে একবার। বিশেষ সময়ে মাসে একবার খাওয়া হয়। সেগুলো শরীরে একমাস সবরকম পুষ্টি পাঠায় ধীরে ধীরে–
তাই বল। রুকাস তাই কিছু খেত না প্রথম প্রথম।
হ্যাঁ, তাকে আমরা দীর্ঘমেয়াদী পুষ্টিকর খাবারের ট্যাবলেট খাইয়ে পাঠিয়েছিলাম।
মা খানিকক্ষণ চোখ বড় বড় করে থেকে বললেন, আচ্ছা বাবা, কাপড়ের ফ্যাশন কি আজকাল? ঢিলেঢালা, নাকি সময় পরিভ্রমণের একটা প্রশ্ন মাথার মাঝে ঘুরঘুর করছে, কিন্তু মায়ের জন্যে মনে হচ্ছে আজ সেটি আর জিজ্ঞেস করা হবে না।
০৭. নূতন জীবন
আমাদের এই এলাকায় এত বড় একটা ব্যাপার ঘটছে, কিন্তু দেখে সেটি বোঝার কোনো উপায় নেই। টবু তার মনমতো একটা প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে পরদিন ভোরে আমার সাথে হাঁটতে বের হল। চমৎকার বসন্তকালের একটি সকাল, ঝোপঝাড়ে বুনো ফুল, পাখি ডাকছে, ঘাসফড়িং লাফাচ্ছে। আকাশ নীল, মেঘের কোনো চিহ্ন নেই।
আমি কিরীণার বাসায় থেমে তাকে খোঁজ করলাম। তার মা বললেন, সে খুব ভোরে তার আইসোটোপ আলাদা করার ছাঁকনিটি নিয়ে সমুদ্রতীরে চলে গেছে। আমি তখন উবুকে নিয়ে সমুদ্রতীরের দিকে হাঁটতে থাকি।
অনেক দূর থেকে আমি কিরীণার গলা শুনতে পাই। সে এবং তার কয়জন বান্ধবী পাশাপাশি বসে সুর করে গান গাইতে গাইতে কাজ করছে। গানের বিষয়বস্তুটি খুব করুণ—ছোট্ট একটি শিশু প্রতিদিন ভোরে সমুদ্রতীরে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। তার বাবাকে ট্রনেরা ধরে নিয়ে গেছে, সে কি আর ফিরে আসবে?
কিরীণার মিষ্টি গলার সেই করুণ সুর শুনে বুকের মাঝে কেমন জানি হা হা করে ওঠে। টুর্ব পর্যন্ত থমকে দাঁড়িয়ে বলল, অত্যন্ত চমৎকার কণ্ঠ, প্রয়োজনীয় তরঙ্গের অপূর্ব সুষম উপস্থাপন।
যার অর্থ নিশ্চয়ই কি সুন্দর গান।
কিরীণা আমাদের দেখে লজ্জা পেয়ে গান থামিয়ে ফেলল। আমি বললাম, কী হল? থামলে কেন?
ভেবেছ তোমাকে গান শোনানো ছাড়া আমাদের আর কোনো কাজ নেই।
টুর মাথা নিচু করে অভিবাদন করে বলল, তোমার গলার স্বরে যে তরঙ্গের উপস্থাপনা আছে সেটি একটি সুষম উপস্থাপনা। আমি নিশ্চিত, মানুষ সম্প্রদায় এই উপস্থাপনার যথাযথ মূল্য দেবো।
কিরীণা একটু অবাক হয়ে টুবুর দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি পরিচয় করিয়ে দিলাম, এ হচ্ছে টুবু। রুকাসের বন্ধু, রুকাসকে সাহায্য করার জন্যে এসেছে। ব্যক্তিগত জীবনে টুবু এক জন রবোট।
টুব মৃদু স্বরে আমাকে মনে করিয়ে দিল, সপ্তম বিবর্তনের চতুর্থ পর্যায়ের ষষ্ঠ প্রজাতির রবোট।
কিরীণা নিজেকে সামলে নিয়ে তার বান্ধবীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। টুকু। সবাইকে অভিবাদন করে বলল, আমার মানুষ সম্প্রদায়কে খুব ভালো লাগে।
আমি হেসে বললাম, সাধারণত এই সময়ে সমুদ্রতীরে অনেক বাচ্চারা থাকে। আজ কেন জানি কেউ নেই।