টুবু নামক রবোটটি এবারে রুকাসের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কেমন করে এত বড় একটা ভুল করলে? তিন তিনটি থার্মোনিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ ঘটালে এক জায়গায়? তুমি কোথায় আছ সেটা কি গোপন আছে আর?
তুমি আমার জায়গায় হলে তাই করতে। আমি তো মাত্র তিনটি বিস্ফোরণ করেছি, তুমি করতে ছয়টি।
টুবু মাথা নেড়ে বলল, আমাকে এক্ষুনি নিয়ে চল তোমার বাসায়। তোমাকে ঘিরে একটা প্রতিরক্ষা ব্যুহ দাঁড় করাতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
আমরা তিনজন আমাদের বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করি।
ঘরের আলোতে আমি প্রথমবার টুবুকে ভালো করে দেখলাম। বড় বড় ফটোসেলের চোখ, ছোট নার্ক এবং বিস্তৃত মুখে তার চেহারায় কেমন জানি একটি সারল্য রয়েছে। তার গলার স্বর খানিকটা ধাতব, যান্ত্রিক, এবং ভাবলেশহীন। আমি উপস্থিত থাকলে সে ভদ্রতা করে আমাদের ভাষায় রুকাসের সাথে কথাবার্তা বলে, যেন আমি বুঝতে পারি। তাদের নিজেদের ভাষা অত্যন্ত সুন্দর, সুরেলা এবং দ্রুত। মাঝে মাঝেই মনে হয় শিস দেয়ার মতো শব্দ হয়।
টুবু তার ঘাড়ের একটা বাক্স খুলে ভিতর থেকে জিনিসপত্র বের করতে থাকে। নানা আকারের ছোট-বড় যন্ত্রপাতি। সেইসব যন্ত্রপাতি খুলে গিয়ে নানা ধরনের আকৃতি নিতে থাকে। ঘন্টাখানেকের মাঝেই রুকাসের ঘরটি একটি অবিশ্বাস্য রূপ নিয়ে নেয়। ঘরের মাঝামাঝি লাল আলোতে এই পুরো এলাকার একটি ত্রিমাত্রিক ছবি ভেসে ওঠে। বাইরে থেকে যে-কেউ আমাদের এই এলাকায় প্রবেশ করার চেষ্টা করলে এই ত্রিমাত্রিক ছবিটিতে তাকে দেখা যাবে। সেটি ধ্বংস করার নানারকম উপায় রয়েছে এবং বন্ধুভাবাপন্ন নয় এরকম মহাকাশযানকে সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। আমাদের কোনো ধরনের মহাকাশযান নেই এবং বাইরে থেকে শুধুমাত্র আমাদের উপর হামলা করার জন্যেই মহাকাশযানগুলো এসে হাজির হয় শুনে টুবু খুব অবাক হল।
রুকাসকে রক্ষা করার জন্যে এই পুরো এলাকা ঘিরে একটা শক্তিবলয় এবং প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে টুবু অন্য কাজে মন দিল। প্রথমে রুকাসকে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখল। রুকাস তার গায়ের কাপড় খুলে বিছানায় শুয়ে থাকে, টুবু তার উপর উবু হয়ে ঝুঁকে তাকে পরীক্ষা করতে থাকে। খানিকক্ষণ পরীক্ষা করে বলল, তোমার শরীর চমৎকার আছে। আমি যে ধরনের আশঙ্কা করেছিলাম সেরকম কিছু হয় নি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি আশঙ্কা করেছিলে?
এখানকার স্থানীয় রোগ-জীবাণু এবং ভাইরাসে রুকাসের শরীর ভ্যস্ত নয়, সে ধরনের কোনো কিছুতে আক্রান্ত হলে তাকে বাঁচানো কঠিন হবে। তার শরীরে নানারকম প্রতিষেধক এবং অ্যান্টিবডি দিয়ে পাঠানো হয়েছে, সেগুলো চমৎকার কাজ করছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, টুকু, যদি রুকাসকে নিয়ে যাবার জন্যে এখানে বায়োবট আসে, তুমি বুঝতে পারবে?
পারার কথা।
তারা কী আসবে?
আজ হোক কাল হোক, তারা আসবে। কেন?
রুকাস যদি বেঁচে থাকে, বায়োটের একটি মহাবিপর্যয় হবার কথা। আমাদের, মানুষের পক্ষে যেরকম রয়েছে রুকাস, বায়োবটদের দিকে তেমনি রয়েছে এক জন—ক্লডিয়ান। এই দুজনের মাঝে এক জন বেঁচে থাকবে, কে বাঁচবে তার উপর নির্ভর করবে সবকিছু।
ক্লডিয়ান! আমি রুকাসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ক্লডিয়ানের কথা শুনেছ?
শুনেছি।
সে কী রকম? কত বয়স? দেখতে কেমন?
আমি ঠিক জানি না।
টুকু বলল, ক্লডিয়ান বর্তমান বায়োবট গোষ্ঠীর দলপতি। তার বয়স সম্ভবত চল্লিশ থেকে ষাটের মাঝে। বায়োবটদের হিসেবে সেটা বলা যায় তরুণ। তাদের আয়ু আজকাল দু’ শ’ পঞ্চাশ থেকে তিন শ’য়ের কাছাকাছি।
সে দেখতে কেমন?
বায়োবটদের নিজেদের চেহারা নেই। অপুষ্ট মুখমণ্ডল যন্ত্রপাতিতে ঢাকা থাকে, সেই যন্ত্রের চেহারা হচ্ছে তাদের চেহারা।
ক্লডিয়ান কী রকম মানুষ?
ক্লডিয়ান মানুষ নয়, বায়োবট।
কিন্তু তার মাথায় এখনো মানুষের মস্তিষ্ক, তার চিন্তা-ভাবনা নিশ্চয়ই মানুষের। রুকাস এবং টুবু দু’জনেই একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল।
টুবু বলল, কিন্তু তাদের শরীর এমনভাবে যন্ত্রের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে, যে, খুব বড় পরিবর্তন হয়েছে তাদের মস্তিষ্কে।
কিন্তু তবুও নিশ্চয়ই তারা মানুষ। তাদের চিন্তা-ভাবনা নিশ্চয়ই মানুষের মতো।
রুকাস মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। তা নিশ্চয়ই সত্যি।
তাহলে তার চিন্তা-ভাবনা কী রকম?
আমি ঠিক জানি না।
টুকু বলল, ক্লডিয়ান খুব নিষ্ঠুর।
সকল বায়োবটমাত্রেই নিষ্ঠুর। ক্লডিয়ান তাদের দলপতি, তার নিষ্ঠুরতা অনেক বেশি।
আমি অবাক হয়ে টুবু এবং রুকাসের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভবিষ্যতের পৃথিবীর পরিণতি কী হবে সেটি নির্ধারিত হবে এই মানুষ এবং রবোটগুলো দিয়ে। পুরো ব্যাপারটি ঘটছে আমার চোখের সামনে, আমার সেটি এখনো বিশ্বাস হতে চায় না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, টুব, তোমাদের এত ক্ষমতা, তোমরা ইচ্ছে করলেই এখন সারা পৃথিবী ধ্বংস করে ফেলতে পার—কেন ভবিষ্যতের সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ-বিগ্রহের মাঝে পড়ে রয়েছ? কেন এখানে থেকে যাও না? সারা পৃথিবীর মাঝে তোমরা হবে সর্বশ্রেষ্ঠ।
টুবু হাসির মতো শব্দ করে বলল, সময় পরিভ্রমণের ব্যাপারটি তুমি জান না বলে তুমি এরকম কথা বলছ। কেউ যখন অতীতে আসে, তাকে খুব সাবধানে থাকতে হয়।
কেন?
সে যদি একটু ভুল করে, ভয়ংকর প্রলয় হয়ে যাবে প্রকৃতিতে। আমরা প্রকৃতির স্বাভাবিক গতির বিরুদ্ধে যাচ্ছি। একটি অকারণ প্রাণীহত্যা হবে ভবিষ্যতের একটা প্রজাতিকে ধ্বংস করে ফেলা। সময়ের অনিশ্চিত সূত্র যেটুকু করতে দেয়, তার ভেতরে থাকতে দেয় সব সময়।