জানতে পারবে না বলি নি, বলেছি জানার সম্ভাবনা কম।
মানে?
যদি অসংখ্যবার চেষ্টা করা যায়, খুব ছোট একটা সম্ভাবনা আছে কাছাকাছি ভবিষ্যৎ থেকে কোনো তথ্য আনার। মনে হয় বায়োবটেরা কিছু-একটা তথ্য এনেছে। যেখানে দেখা গেছে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু-একটা করেছি। কী করেছি আমি জানি না।
তুমি জান না তুমি কী করেছ, কিন্তু সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ?
হ্যাঁ। তাই আমাকে অক্ষত লেহে বেঁচে থাকতে হবে। যেভাবে হোক। বায়োবটেরা এত ভয়ঙ্করভাবে আমাকে খুঁজে বের করে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে, যে, আমাকে বাঁচিয়ে রাখার একটিমাত্র উপায়–।
সেটা হচ্ছে অতীতে সরিয়ে ফেলা?
হ্যাঁ, আমি অজ্ঞাত কোনো জায়গায় লুকিয়ে না গিয়ে অজ্ঞাত কোনো সময়ে লুকিয়ে গেছি।
আমি অবাক হয়ে রুকাসের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
০৬. টুবু নামের রবোট
মায়ের অনাথাশ্রমের জন্যে একটা বড় কেক নিয়ে গিয়েছিলাম। একটি শিশুর জন্মদিন ছিল আজ। মা বড় একটা কেক তৈরি করেছিলেন। উপরে বড় বড় করে তার নাম লেখা ছিল। ট্রনেদের হাতে তার বাবা-মা মারা না গেলে আজ তার নিজের বাসায় কত চমৎকার আনন্দোৎসব হত।
আমার আরো আগে ফিরে আসার কথা ছিল, কিন্তু জন্মদিনের উৎসবটি এত আনন্দঘন হয়ে উঠল যে দেরি হয়ে যাচ্ছে জেনেও আমি উঠে আসতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত যখন রওনা দিয়েছি তখন বেশ রাত হয়ে গিয়েছে।
সমুদ্রতীর ধরে হেঁটে আসছি, কোথাও কেউ নেই। মস্ত একটা চাঁদ উঠেছে। আকাশে। চারদিকে তার নরম জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছে। চাঁদের আলোতে সবকিছু এত মায়াময় মনে হয় কেন কে জানে।
আমি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের পানিতে চাঁদের প্রতিফলনটি উপভোগ করলাম। শান্ত সমুদ্র, ছোট ছোট ঢেউ কুলে এসে ভেঙে পড়ছে। খানিকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছি, দেখতে পেলাম আমার ঠিক সামনে এক জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভয়ানক চমকে উঠে বললাম, কে?
মানুষটি একটু এগিয়ে এল, আমি একটা ধাতব শব্দ শুনতে পেলাম। এর শরীর ধাতব পদার্থে তৈরী! মানুষটি শিস দেয়ার মতো একটা শব্দ করল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কে তুমি?
মানুষটি বিজাতীয় ভাষায় কিছু-একটা বলল, আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। আমি ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে বললাম, কে? কে তুমি?
মানুষটি আরো খানিকক্ষণ নানা ধরনের বিচিত্র ভাষা বলে হঠাৎ পরিস্কার আমার ভাষায় বলল, তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ?
নিশ্চয়ই পৃথিবীর সব রকম ভাষায় চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত আমাদের ভাষাটি খুঁজে পেয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, পারছি।
চমৎকার। লোকটি আরো এগিয়ে আসে, আমি এবারে চাঁদের আলোতে তাকে স্পষ্ট দেখতে পাই। লোকটি মানুষ নয়, তার পুরো দেই ধাতব। অনেকটা রবোটের মতো, কিন্তু এরকম রবোট আমি আগে দেখি নি। রবোটের মতো মানুষটি বলল, এই এলাকায় কয়েকদিন আগে তিনটি থার্মোনিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ ঘটেছে?
আমার খানিকক্ষণ লাগল বুঝতে সে কী জানতে চাইছে। হঠাৎ বুঝতে পারলাম সে ট্রনেদের তিনটি মহাকাশযান ধ্বংসের কথা বলছে। আমি কী বলব বুঝতে না পেরে বললাম, কেন?
সেই বিস্ফোরণলো কেমন করে ঘটেছে? এক জন তরুণ কি তার শরীরের ভেতর থেকে একটা অস্ত্র বের করে বিস্ফোরণগুলো ঘটিয়েছিল?
আমি কুলকুল করে ঘামতে থাকি। এই প্রাণীটি নিশ্চয়ই বায়োবট, রুকাসের খোজে এসেছে।
প্রাণীটি আবার জিজ্ঞেস করল, কেমন করে হয়েছিল সেই বিস্ফোরণ?
আমি জানি না।
তুমি নিশ্চয়ই জান। তোমার গলার কাঁপন থেকে আমি বুঝতে পারছি তুমি মিথ্যা কথা বলছ। আমাকে বল সেই তরুণটি কোথায়।
আমি বলব না।
ভয়ঙ্কর সেই ধাতব দেই আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে ভেবে আমি আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেললাম, কিন্তু সেটি আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল না। বলল, তরুণটিকে আমার খুব প্রয়োজন। আমাকে তার কাছে নিয়ে যাও।
না।
তুমি নিশ্চয়ই আমাকে তার কাছে নিয়ে যাবে। রবোটের মতো প্রাণীটি তার হাত বাড়িয়ে হঠাৎ আমার মাথায় স্পর্শ করে, উচ্চচাপের বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো একটা অনুভূতি হয় আমার, ইচ্ছে-অনিচ্ছে বলে কিছু থাকে না আমার! চোখের সামনে লাল একটা পর্দা খেলতে থাকে, তা হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ রুকাসের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম আমি, টু।
রবোটের মতো প্রাণীটি সাথে সাথে ছেড়ে দিল আমাকে, তারপর ছুটে গেল রুকাসের দিকে, শিস দেয়ার মতো শব্দ করল মুখে একবার বিজাতীয় ভাষায়। আমি কোনোমতে উঠে দাঁড়ালাম, পুরাতন বন্ধু এক জন আরেকজনকে যেরকম গভীর ভালবাসায় আলিঙ্গন করে, তেমনি করে রুকাস আলিঙ্গন করছে প্রাণীটাকে। এই রবোটের মতো প্রাণীটা আর যাই হোক, বায়োবট নয়। দ্রুত কোনো এক ভাষায় এক জন আরেকজনের সাথে কথা বলছে, দেখে মনে হয় কথা কাটাকাটি হচ্ছে, কিন্তু রুকাসের মুখে হাসি, নিশ্চয়ই ভাষাটিই এরকম।
একটু পরেই দু’জনে আমার দিকে এগিয়ে এল। রবোটের মতো প্রাণীটি আমার সামনে মাথা নিচু করে অভিনন্দন করার ভঙ্গি করে বলল, তোমার মস্তিষ্কে বিদ্যুৎপ্রবাহ করানোর জন্যে দুঃখিত।
আমি বললাম, ভেবেছিলাম তুমি বায়োবট। আমি জানতাম না রুকাস তোমার বন্ধু।
রুকাস?
রুকাস হেসে বলল, হ্যাঁ, এখানে আমার নাম রুকাস!
রুকাস! কি আশ্চর্য নাম!
আমি রবোটটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কি? তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ?
আমি টুবু। আমি সপ্তম বিবর্তনের চতুর্থ পর্যায়ের ষষ্ঠ প্রজাতির রবোট। রুকাসকে রক্ষা করার প্রাথমিক দায়িত্ব আমার উপর ছিল। যেহেতু তার গোপনীয়তা নষ্ট হয়েছে, আমাকে তার সাহায্যের জন্যে আসতে হয়েছে।